বাস মালিকদের ঘোষণার পরও কেন নৈরাজ্য?
পরিবহন মালিকদের ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে সম্প্রতি দেশজুড়ে পরিবহন ধর্মঘটে তৈরি হয় অচলাবস্থা। আবার সংবাদ সম্মেলন করে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই চালু হয়ে যায় সব বাস। এখন আবার এই মালিক সমিতির ঘোষণা, এমনকি বিআরটিএর অভিযানে অংশ নেয়ার মধ্যেও রাজধানীতে বাসে কমছে না অতিরিক্ত ভাড়া আদায়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির অভিযোগ, পরিবহন মালিকরা গণমাধ্যম আর সরকারের সঙ্গে বৈঠকে কথা বলেন এক রকম, আর কাজ করেন অন্য রকম। নইলে তাদের পূর্ব ঘোষণার পরও কেন সিটিং সার্ভিস নামে অবৈধ বাস চালনা বন্ধ হবে না আর বাসে কেন বিআরটিএর ভাড়ার চার্ট থাকবে না-সে প্রশ্নও তুলেছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির একজন নেতা।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা আছে এটা মনেই হয় না। কেউ কোনো আইন মানতে চায় না। এ জন্য সাজাও পেতে হয় না। তিনি সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন।
গত কয়েক বছর ধরেই বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা আদায় সিটিং, স্পেশাল, ডাইরেক্ট বা কম স্টপেজ নামে নানা সার্ভিস চালু করে পরিবহন মালিকরা। প্রতি বাসে শতকরা ৮০ শতাংশ যাত্রী ভরাট থাকে-এটা ধরেই ভাড়া নির্ধারণ করে বিআরটিএ। কিন্তু রাজধানীতে আসন খালি নিয়ে বাস চলে এটা ভাবাই যায় না। তার ওপর নানা কৌশলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়।
এমন একটি কৌশল সিটিং সার্ভিস নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মাস দুয়েক আগে তার অসন্তোষ জানান প্রকাশ্যেই। এরপর গত ৪ এপ্রিল বাস মালিক সমিতি ঘোষণা দেয় পকেট কাটার সিটিং সার্ভিস বন্ধ হবে ১৫ এপ্রিল থেকে।
কিন্তু কথা রাখেনি তারা। এরপর সেদিনই সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ বৈঠকে বসে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত হয় ১৬ এপ্রিল থেকে চলবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান।
ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাসে দৃষ্টিগ্রাহ্য স্থানে বিআরটিএর ভাড়ার তালিকা থাকার কথা। বিআরটিএর নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া সাত টাকা আর মিনিবাসে পাঁচ টাকা। কিন্তু বড় বাসে ১০ টাকার কম ভাড়া নেয়ার উদাহরণ বিরল। এ নিয়ে নিয়মিত বাসে বসচাও হচ্ছে।
অভিযান শুরুর পর বেশ কিছু সিটিং সার্ভিস লোকালে পরিণত হয়েছে বটে, কিন্তু সিটিং নামে যত ভাড়া আদায় করা হচ্ছিল, এই লোকালেও ভাড়া নেয়া হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে একই হারে। আবার যাত্রীদের ‘শিক্ষা’ দিতে গরমের ঠাসাঠাসি করে লোক তোলা, প্রতিটি স্টপেজে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকা, বাস বন্ধ করে রাখার ঘটনাও ঘটছে।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে বিআরটিএর অভিযানে আবার অংশ নিচ্ছেন পরিবহন মালিকরাও। মালিকদের সমিতির নেতারা প্রকাশ্যে বলছেন, অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না।
আপনারাই মালিক, আবার আপনাদের বাসই অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে, আপনারা আবার ভ্রাম্যমাণ আদালতেও আসছেন। তাহলে কি আসলে এরা প্রকাশ্যে এক কথা আর গোপনে শ্রমিকদেরকে অন্য কিছু বলেন?-জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলা এমটিসিএলের পরিচালক শরীফ উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে পাঁচ ছয় বাস বৈঠক করেছি, বলেছি চার্ট অনুযায়ী ভাড়া নিতে। কিন্তু দেখা যায় তারা এটা মানে না।’
আপনারা মালিক, আপনাদের কথার বাইরে চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করবে-এটা বিশ্বাসযোগ্য কেন হবে- জানতে চাইলে এই পরিবহন মালিক বলেন, ‘তাদের ওপর তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা সকালে বের হয় গাড়ি নিয়ে এরপর কোথায় কী করেছে, তা তো আর বলতে পারি না।’
যাত্রীদের মধ্যে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাঁচ শতাংশের বেশি নয় বলেও দাবি করেন শরীফ উদ্দিন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, তাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, মালিকরা শ্রমিকদেরকে বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া নেয়ার কথা বলেননি। তিনি বলেন, ‘আগে এই (পরিবহন) সেক্টর চোরের হাতে ছিল, এখন পড়েছে ডাকাতের হাতে। সরকার মালিকদের আজ্ঞাবহ হয়ে যাচ্ছে, মালিকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সরকারের যেখানে কর্তৃত্ব থাকার কথা, সেখানে কর্তৃত্ব হারাচ্ছে। এখানে সরকারের ইমেজ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
মোজাম্মেলও মনে করেন বাস মালিকরা চালাকি করেছে। তিনি বলেন, ‘সিটিং বন্ধ করা হল, এই বন্ধের মধ্য দিয়ে যে বাসগুলো লোকাল চলতো, তাদেরকেও বাড়তি ভাড়া নেয়ার বৈধতা দেয়া হলো। বাড়তি ভাড়া নেয়াটাকে জায়েজ করার হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে তারা।’
নগর পরিকল্পাবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, বিআরটিএ যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে সেটা হবে না। কেবল চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে চলবে না। মালিককেও আনতে হবে আইনের আওতায়। নইলে এর সমাধান হবে না।
ঢাকাটাইমস/১৮এপ্রিল/জিএম/ডব্লিউবি
মন্তব্য করুন