পাবনার ইছামতি এখন ময়লার ভাগাড়

খাইরুল ইসলাম বাসিদ, পাবনা থেকে
 | প্রকাশিত : ১৯ এপ্রিল ২০১৭, ১০:২৯

পাবনা শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের স্রোতস্বিনী ঐতিহ্যবাহী ইছামতি নদী এখন ময়লা-আবর্জনা ফেলার জায়গা হয়েছে। এতে দূষিত হচ্ছে বাতাস। বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে পাবনা শহর। পাশাপাশি দুই পাড়ে চলছে দখল। মরা খালে পরিণত হওয়া নদীটির দখল বা দূষণ রোধে নেই কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা।

জানা যায়, বাংলার নবাব ইসলাম খাঁ ১৬০৮-১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে সৈন্য পরিচালনার সুবিধার্থে পদ্মা ও যমুনা নদীর সংযোগ স্থাপনার্থে পাবনা মধ্য শহরে একটি খাল কাটেন, যার নাম দেন ইছামতি। এক সময়ের খরস্রোতা এই নদী দিয়ে চলতো নৌকা-ছোট জাহাজ। এই নদী দিয়েই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নিজস্ব বোটে শাহজাদপুর আসা-যাওয়া করতেন। কিন্তু সেই স্রোতস্বিনী প্রবহমান ইছামতি তার যৌবন হারিয়ে আজ মৃতপ্রায়। অস্তিতই বিপন্নের পথে।

মধ্য শহরে প্রবাহিত ইছামতি নদীকে এখন সবাই আক্ষেপ করে বলেন, ‘ময়লা আবর্জনার ভাগাড়’ বা ‘পৌরসভার ড্রেন’। নদীর দুই পাড় দখল করে বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মহোৎসব চলছে। শহরের সব বাসা বাড়ি, হোটেল রেস্তোরাঁর আবর্জনা, ক্লিনিকের যাবতীয় বর্জ্য পদার্থ ও আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে। স্লুইস গেট দিয়ে পানি আটকে পরিকল্পিতভাবে নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। অব্যাহত দূষণের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে জেলা শহর ও এর আশপাশের কয়েক লাখ মানুষ।

পাবনা থেকে বেড়া পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর প্রায় অর্ধেক এখন নর্দমা। এর মধ্যে পৌর এলাকার মধ্যে রয়েছে পাঁচ কিলোমিটার। নদী ভরাটের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বর্তমানে ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ ও মশা-মাছির আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে উৎসমুখের কাছে (বাংলাবাজারে স্লুইস গেট) প্রায় ভরাট করে ফেলায় এ নদী হয়ে পড়েছে প্রাণহীন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এ নদীতে প্রবাহ ছিল। এ নদী পাবনার উত্তর প্রান্ত দিয়ে পূর্বে আতাইকুলার পাশ দিয়ে নদীরূপে এগিয়ে গেছে। সাঁথিয়া সদরের পাশ দিয়ে বেড়া সদরের বৃ-শালিখা এলাকার হুরাসাগর নদীতে গিয়ে যমুনায় মিশেছে।

১৯৭৮ সালে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করার সময় ইছামতির সাথে বড়াল নদের সংযোগ মুখে নির্মাণ করা হয় স্লুইস গেট। এ ছাড়া বেড়ার কাছেও ইছামতির প্রান্তখাত বন্ধ করে দেয়া হয়। বেড়া থেকে আতাইকুলা পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার ইছামতি পুনঃখনন করা হয়। বেড়া পাম্প হাউজের সাহায্যে খননকৃত অংশের নদীতে ভরে পানি রাখা হচ্ছে সেচ কাজের জন্য। কিন্তু অবশিষ্ট ২০ কিলোমিটার নদী ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শহরের নর্দমাগুলোর চেয়ে ইছামতির তলদেশ উঁচু হয়ে উঠেছে। দখল হয়ে গেছে নদীর কিনারা। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ডিএস মৌজা ও ম্যাপ অনুযায়ী ২০০৫ সালে সর্বশেষ জরিপ কাজ চালায় জেলা প্রশাসন।

সেই জরিপের তথ্য হিসেবে, নদীর উৎসমুখ সদরের চর শিবরামপুর থেকে পাবনা পৌর এলাকার শালগাড়িয়া শ্মশানঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ কিলোমিটারব্যাপী সাতটি মৌজায় নদীর পাঁচ হাজার বর্গফুট এলাকা বেদখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে ১২০ থেকে দুইশ ফুট প্রস্থের ইছামতি নদী এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ ফুটে। নদীর পাড় দখল করে বসবাস করা অবৈধ দখলদারদের সংখ্যা ২৮৪ জন। ২০০৫ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নদীর কিছু খনন ও পরিষ্কারের কাজ করে।

এ ছাড়া ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নদী খননের জন্য প্রায় ২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বর্জ্য অপসারণ ও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হলেও তা আর শেষ হয়নি।

পরিবেশবিদ অধ্যাপক শাহনেওয়াজ সালাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ইছামতি নদী মরে যাওয়ার বিরূপ প্রভাবে শহরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বিশুদ্ধ পানির সংকটের পাশাপাশি বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। নদীকেন্দ্রিক ফসল উৎ্পাদনও প্রায় বন্ধ।’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কামরুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই নদী অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। স্বপ্ন দেখি আবারো প্রবহমান হবে ইছামতি। আর নদীর দুই ধারে থাকবে গাছের সারি। বিনোদনের একটা জায়গা হয়ে উঠবে ইছামতি। যৌবন ফিরে পেয়ে সকলের জন্য ভূমিকা রাখবে এই নদী। ইছামতি নদী খনন করে পদ্মার সাথে সংযোগ করলে জমে উঠবে ব্যবসা-বাণিজ্য। যাতায়াতে নতুন ব্যবস্থায় সমৃদ্ধ হবে পাবনা।’

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারোফ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ইছামতি নদী উদ্ধারের বিষয়ে অনেকবারই বিভিন্ন ফোরামে বলা হয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের অভাবে কাজ করা হয়নি। এবার তাদের জেলায় ভূমিমন্ত্রী আছেন, আরও চারজন সংসদ সদস্য আছেন। সবার সাথে কথা বলে সমন্বিতভাবে নদীকে উদ্ধারে কাজ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

পাবনার জেলা প্রশাসক রেখা রানী বালো ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নদী ভরাট হওয়ায় এবং বিভিন্ন অবৈধ দখলদারদের জন্য এখন আর পূর্বের অবস্থায় নেই। এ ব্যাপারে পাবনাবাসীকে সচেতন হতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’ নদী উদ্ধারে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কাজ করছেন বলে জানালেন তিনি।

পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম ঢাকাটাইমসকে জানান, ২০১১ সালে ইছামতি নদী পুনঃখনন ও পাবনা শহর এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রায় ১০ কোটি টাকার এই প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় ২০০৪ সালের ৮ জানুয়ারি। কিন্তু পরে সেই প্রকল্পটি আর বাস্তবায়ন হয়নি।

(ঢাকাটাইমস/১৯এপ্রিল/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :