‘নেক ব্লাস্ট’ আতঙ্কে কুড়িগ্রামের চার লক্ষাধিক কৃষক
কুড়িগ্রামে বোরো ক্ষেতে ‘নেক ব্লাস্ট’ (গলা পচা) নামক রোগ দেখা দেয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন জেলার চার লক্ষাধিক কৃষক। কৃষি বিভাগের পরামর্শে সংক্রমিত জমিতে কীটনাশক স্প্রে করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না কৃষকদের। প্রথমে জমির কোনো এক জায়গায় নেক ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয় এবং পরে তা মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ছে পুড়ো জমিতে।
অন্যদিকে যেসব বোরো ক্ষেতে এখনো নেক ব্লাস্ট দেখা দেয়নি সেসব জমিতে এই রোগ ছড়ানোর আশঙ্কায় নিয়মিত স্প্রে করেও আতঙ্কে রয়েছেন ভালো জমির মালিকরা। নেক ব্লাস্টের আক্রমণের ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের।
জেলার নয় উপজেলায় ধান ক্ষেতে নেক ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কে দিন কাটছে কৃষকদের।
কৃষি বিভাগের লিফলেট ও পরামর্শ মোতাবেক বোরো ক্ষেতে ট্রাইসাইক্লোজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে ঔষধের কার্যকারিতা এবং কৃষি বিভাগের পিসক্রিপশনের ঔষধ এই রোগের জন্য প্রযোজ্য কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কৃষকরা।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে চলতি বোরো মৌসুমে কুড়িগ্রামের নয় উপজেলায় এক লাখ ১০ হাজার ৫০২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। ধানের ফলন ভালো হলেও হঠাৎ করে আবহাওয়ার প্রতিকূলতায় দ্রুততম সময়ে ছড়িয়ে পড়ছে নেক ব্লাস্ট। এ রোগ প্রতিরোধে কৃষকের মাঝে লিফলেট বিতরণসহ নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ। আক্রান্ত জমিতে প্রতিশোধক হিসেবে ট্রাইসাইক্লোজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক এবং ভালো জমিতে প্রতিরোধক হিসেবে কারবেনডাজিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছেন কৃষকরা। কিন্তু সংক্রমিত জমিতে ছত্রাক নাশক স্প্রে করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। স্প্রে করার পরও এক থেকে দুই দিনের মধ্যেই এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে পুড়ো জমিসহ পাশ্ববর্তী জমিতে। এ অবস্থায় কৃষকের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা ধান ক্ষেত সাদা হয়ে চিটা হয়ে যাওয়া মহা দুঃচিন্তায় পড়েছেন তারা। নির্ঘুম রাত কাটছে ভালো জমির মালিকদের।
কৃষি বিভাগ জানায়, বৈরী আবহাওয়ার কারণে এ রোগ দেখা দিয়েছে। তা প্রতিরোধে লিফলেট বিতরণসহ নিয়মিত এবং সঠিক মাত্রায় ছত্রাক নাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের পাচপীর এলাকার রিকশাচালক আব্দুল হামিদের স্ত্রী জুলেখা বেগম বলেন, আমি ৪৮ শতক জমি বর্গা নিয়ে বোরো চাষ করেছি। হঠাৎ দেখি ধানের শীষ সাদা হয়ে যাচ্ছে। পরে কৃষি বিভাগের লোক এসে ওষুধ লিখে দিলে সে মোতাবেক স্প্রে করি। কিন্তু পরদিন এসে দেখি সব শীষ সাদা হয়ে গেছে। এখন আর বাঁচার উপায় নেই।
একই গ্রামের আবুল হোসেন, আবুল কাশেম, আব্দুল মজিদ, কাইয়ুম আলী অভিযোগ করেন কৃষি বিভাগের দেয়া পরামর্শ মোতাবেক তাদের উপস্থিতিতেই জমিতে ছত্রাক নাশক স্প্রে করেও কাজ হচ্ছে না। একরের পর একর জমির ধান চিটা হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন বলে জানান তারা।
উলিপুর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নকুল কুমার বলেন, আবহাওয়া প্রতিকূল হওয়ায় নেক ব্লাস্ট দেখা দিয়েছে। আমরা কৃষকদেরকে ট্রুপার, দিপা, সালফাইটার দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। আর যেসব জমি এখনো সংক্রামিত হয় নাই বা কেবল দেখা দিয়েছে সেসব জমিতে প্রতিরোধক হিসেবে কাসোবিন, নাটিভো এগুলো স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি।
জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের কৃষক শফিউল আলম জানান, নেক ব্লাস্টের ভয়ে তিনি জমিতে ছত্রাক নাশক স্প্রে করেছেন। কিন্তু একদিন পর জমিতে গিয়ে দেখি দুই একর জমির ধান সব সাদা হয়ে গেছে। এখন সামনে শুধু অন্ধকার দেখছি।
ফসল বাঁচাতে তেল-সারসহ প্রয়োজনীয় খরচ মিটানোর পরও বেশি দামে কীটনাশক কিনে জমিতে প্রয়োগ করেও শেষ রক্ষা করতে পারছেন না তারা। এ অবস্থায় চড়া দামের কীটনাশক স্প্রে করেও আতঙ্ক কাটছে না আক্রান্ত না হওয়া জমির কৃষকের।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মকবুল হোসেনের কাছে ওষুধে কাজ না হওয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কৃষি বিভাগের দেয়া প্রেসক্রিপশনের বাইরে কিছু ব্যবসায়ী ব্লাস্ট রোগের ঔষধ ছাড়া সাধারণ ধান পচা রোগের ঔষধ বিক্রি করছেন। যে সব কৃষক কীটনাশক ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতারিত হয়ে পিসক্রিশনের বাইরে ঔষধ কিনে স্প্রে করছেন। এসব জমিতে নেক ব্লাস্ট দমন সম্ভব হচ্ছে না। এ রোগ বর্তমানে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি আর যেন কোনো কৃষকের ক্ষতি না হয়।’
খাদ্যে উদ্বৃত্ত কুড়িগ্রাম জেলার বোরো ফসল বাচাতে কৃষি বিভাগসহ সরকারের দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ কামনা করছেন এ জেলার কৃষকরা।
(ঢাকাটাইমস/২০এপ্রিল/প্রতিনিধি/জেবি)
মন্তব্য করুন