ঢাকা থেকে দিল্লি কাছে, কলকাতা দূরে

সৈয়দ তানভীর নাসরীন
| আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০১৭, ১১:১৪ | প্রকাশিত : ২০ এপ্রিল ২০১৭, ১১:১১

আপাতদৃষ্টিতে তিস্তা চুক্তি নিয়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি, প্রধানমন্ত্রী মোদিরও কোনও রাজনৈতিক লাভ হয়নি। কিন্তু ভারত সফর সেরে ফেরার পর বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাংবাদিক সম্মেলন বলে দিচ্ছে এখনও পর্যন্ত ‘অ্যাডভান্টেজ মোদি’। শেখ হাসিনা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, মোদির প্রতিশ্রুতিতে তাঁর যথেষ্ট ভরসা ‘পানি কেউ আটকে রাখতে পারবেন না।’

পরিস্থিতিটা মনে রাখতে হবে। সবে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন শেষ হয়েছে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী যোগী আদিত্যনাথকে লখনৌর কুর্সিতে বসানো হয়েছে। হাসিনার ভারত সফরের আগের কয়েকদিনও বাংলাদেশের মিডিয়া আচ্ছন্ন ছিল উত্তরপ্রদেশে কসাইখানা বন্ধ কিংবা রাজস্থানের অলওয়রে গরু নিয়ে যাওয়ার অপরাধে মুসলিম যুবককে পিটিয়ে মারার খবরে। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির প্রায় সব দৈনিকেই প্রথম পাতায় যতটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হচ্ছিল শেখ হাসিনা-র দিল্লি সফরের খবর, প্রায় ততটাই গুরুত্ব পাচ্ছিল ভারতের শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে মুসলিমবিদ্বেষের অভিযোগের খবর। এই পরিস্থিতিতে জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের চতুর্থ মুসলিমপ্রধান দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে পা রেখেছিলেন। এবং বিমানবন্দরেই প্রথম চমকটা দিয়ে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। প্রোটোকল অনুযায়ী একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে, যাকে বলা হয় ‘মিনিস্টার ইন ওয়েটিং‘, শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনার দায়িত্ব দিয়েও তিনি নিজেই বিমানবন্দরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আসলে মোদি জানেন, পররাষ্ট্র নীতি দিয়ে তিনি যে নতুন ‘আইকন’ হিসেবে ছাপিয়ে যেতে চান জওহরলাল নেহরুর ভাবমূর্তিকে, তাতে মুসলিম বিশ্বকে বাদ দিয়ে কিছু হবে না। বিশেষত ঘরের পাশে যে মুসলিমপ্রধান দেশে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের বাস, তার জন্য সদর্থক বার্তা দেওয়াই বুদ্ধিমানের লক্ষণ।

এই সফরে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা বিষয়ে সহযোগিতার জন্য চুক্তি হয়েছে, সমঝোতা হয়েছে জ্বালানি ক্ষেত্রে, ভুটান থেকে বিদ্যুৎ যাতে ভারতের মাটি দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া যায় সেই বাধাও দূর হয়েছে। কিন্তু তবুও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে ছেয়ে রেখেছে তিস্তা প্রসঙ্গ। মিডিয়া পণ্ডিতদের একটা বড় অংশ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, যে তিস্তা চুক্তি অবিলম্বে না হলে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের ভরাডুবি অনিবার্য। যারা এই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন, তারা আসলে শেখ হাসিনার বিষয়ে কিছু সরল তথ্য ভুলে যান। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে শেখ হাসিনাই হবেন প্রথম সাংবিধানিক প্রধান, যিনি টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলেন, জিয়াউর রহমান (১৯৭৭-১৯৮২) বা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (১৯৮২-১৯৯০) যা করে দেখাতে পারেননি। শেখ হাসিনার বর্তমান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া তো অনেক পিছিয়ে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে, যেখানে সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক হত্যা অতিপরিচিত বিষয়, সেখানে ইতিমধ্যেই মুজিব-কন্যা কতটা কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, সেটা আমাদের বোঝার সময় এসেছে।

নিয়মিত বাংলাদেশ যাতায়াতের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, গত কয়েক বছরে কত বার শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক দিক থেকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় অনেকেই শেখ হাসিনার ‘পলিটিক্যাল অবিচুয়ারি’ লিখে দিয়েছিলেন। ধরেই নিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার বিএনপি নির্বাচন বয়কট ও রাস্তায় নেমে আন্দোলনের হুমকি অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। ঠিক, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টিতেই কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। এও সত্যি, বিরোধীদের বয়কট করা সেই নির্বাচনকে ‘মান্যতা’ দিতে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের অনেক দেশ, এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রাজি ছিল না। কিন্তু সে দিন মনমোহন সিং সরকারও এতটাই জোরের সঙ্গে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিল, আজ যতটা প্রত্যয়ের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি আওয়ামী লীগ সরকারের পাশে রয়েছেন। অর্থাৎ, শেখ হাসিনা তাঁর নিজের মতো করে উপমহাদেশের রাজনীতিটা ভালই বোঝেন এবং আওয়ামী লীগকে যতই ‘কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ’ বলে বিরোধীরা প্রচার করুক, নয়াদিল্লিতে বিজেপির আধিপত্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সমীকরণ তিনি ভালই তৈরি করে নিতে পেরেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর, শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অর্থনীতিবিদ আতিউর রহমান আলাপচারিতায় আমাদের বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার রোল মডেল হতে পারেন মালয়েশিয়ার মাহাথির। যদি শেখ হাসিনা একটু বেশি সময় বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় থাকেন, তা হলে উন্নয়নের যে মডেল তিনি অনুসরণ করছেন, তা বাংলাদেশকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।’ গ্রামীণ অর্থনীতি, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নের যে প্রক্রিয়া শেখ হাসিনা শুরু করেছেন, তাকে অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন অমর্ত্য সেন এবং জঁ দ্রেজ। অতএব তিস্তা নিয়ে সংশয় থাকলে ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার নির্বাচনী বৈতরণী পার করা মুশকিল, এটা বোধ হয় বেশি সহজ সমীকরণ হয়ে যাবে। বরং এটা নিশ্চিন্তে বলা যায়, ২০১৮ সালে আরও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় চলে এলে শেখ হাসিনা সত্যিই রাজনৈতিক নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন নজির তৈরি করবেন, যা থাইল্যান্ডে থাকসিন সিনায়াত্রা করতে পারেননি, পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোও করতে পারেননি। এই জন্যই হয়তো খালেদা জিয়া ঢাকায় বসে অভিযোগ তুলেছেন, পরবর্তী পাঁচ বছরও ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে এসেছেন!

তিস্তা নিয়ে জটিলতা রয়েছে, এটা ধরে নিয়েই কিন্তু দিল্লি এবং ঢাকা গত কয়েক মাস ধরে দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি নদী অববাহিকা বা ‘রিভার ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ নিয়ে কথা বলছে। বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন স্রিংলা এর আগেও দুই দেশের মধ্যে স্থলচুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তখন তিনি দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ডেস্কের দায়িত্বে ছিলেন, এখন তিনিই ঢাকায়। অতএব তিস্তা হোক, তোর্সা হোক, উত্তরবঙ্গের যে সব নদী বাংলাদেশে গিয়ে ঢুকছে, সেই নদীগুলির ‘রিভার ব্যাংক’ ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে যে ঢাকার পিপাসা পূরণ করতে হবে, এটা ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে।

দিল্লি আপাতত ঢাকার অনেক কাছের। বরং ঢাকা থেকে কলকাতা অনেক দূরের। অ্যাডভান্টেজে থাকা নরেন্দ্র মোদির জন্য এটাই আপাতত অস্বস্তির বিষয় যে, বেজিংকে ঢাকা থেকে দূরে রাখতে তার সরকারের এত কৌশল, এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চলেছেন সেই লাল চীনের উদ্দেশ্যেই।

লেখক: বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক

সূত্র: আনন্দবাজার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :