সাম্প্রতিক

রাজধানীর গণপরিবহনে অরাজকতা এবং কবিদের ভাবনা

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ২০ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:১৩

কবিরা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। সাধারণ মানুষের চিন্তার দ্বার যেখানে রুদ্ধ, সেখানে শুরু হয় কবির নান্দনিক ভাবনার সূচনা। হঠাৎ করে কবি-বন্ধনার অর্থ এ নয় যে, ফেলে আসা যৌবনের কবিতাপ্রীতি আবার উসকে উঠেছে। সম্প্রতি নগর পরিবহন নিয়ে হঠাৎ করে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি, জনদুর্ভোগ ও যোগাযোগমন্ত্রীর অসহায়ত্ব দেখে কবিদের বচন মনে পড়ল। রাজধানীর গণপরিবহনের কয়েকদিনের অরাজক অবস্থার সমান্তরালে ভাবা যায় বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী অন্তত তিন কবির অনুভূতি।

জীবনানন্দ দাশের কবিতার চরণ, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ কবির এ আবেগাশ্রিত অনুভূতির সঙ্গে মিল রেখে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সিটিং সার্ভিসের ছদ্মাবরণে রাজধানীর সড়ক পরিবহনে চলে আসা ‘চিটিং’ বন্ধ করার নামে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার প্রয়োজন হঠাৎ হলো কেন? একি নগরবাসীকে প্রশান্তি দেওয়ার বাসনা? এ দুটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে।

সর্বাঙ্গে সমস্যার দগদগে ঘা নিয়ে অহমের বত্রিশ দন্ত বিকশিত করে চলছে সড়ক পরিবহনখাত। এ খাতের অতি সাধারণ একটি সমস্যার বিরুদ্ধে ১৬ এপ্রিল তালপাতার সিপাহির শক্তি নিয়ে মহারণে নামল কেন সরকারি সংস্থা! এর আগে নগর পরিবহনের দেড়শ কোম্পানির প্রতিনিধিদের আহূত বৈঠকে ১৪০টি কোম্পানির প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন এমনটাই দাবি করেছেন ঢাকা সড়ক পরিবহনখাতের এক নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি আবার ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত। মজার বিষয় হচ্ছে, সিটিং সার্ভিস বন্ধের নামে সরকারি সংস্থার অভিযানের সময় এ নেতার লোকেরা সক্রিয় ছিলেন সমান্তরালে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি অভিযানে মালিক সংগঠনের একটি অংশকে সম্পৃক্ত করতে হলো কেন? এ প্রশ্নের সূত্র ধরেই সংশয় দেখা দিয়েছে, এ আসলে সিটিং সার্ভিসের নামে প্রকাশ্যে চলে আসা ‘চিটিং’ থেকে যাত্রীদের পরিত্রাণ দেওয়া নয়; এ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কাউকে নতুন মাফিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেওয়া।

আর এটি টের পেয়েই প্রতিষ্ঠিত মাফিয়াদের ইঙ্গিতে রাজধানী হয়ে যায় প্রায় গণপরিবহন শূন্য। আর এর অনিবার্য ফলে দুর্বিষহ নগরজীবনে নেমে আসে নরকের অশ্বস্তি। কারো মতে আবার, বেআইনিভাবে চলে আসা সিটিং সার্ভিসের বিষয়টিকে আইনি কাভারেজ দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্যই একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। যাতে বাসযাত্রীদের চলমান ‘গলা কাটা’ অধিকতর সহজ হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নয়, এর সঙ্গে আর একটি অপ-উদ্দেশ্য থাকতে পারে, বাস-মিনিবাস কমিয়ে দিয়ে মুরগি বহনের মতো যাত্রী পরিবহন করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা অথবা পরিবহনখাতে সাবসিডির নামে লাভবান হওয়া।

সন্দেহের এসব গরল ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সরল চিন্তা করা যাক। ধরে নেই, সরকার ও পরিবহন মালিকপক্ষ আসলেই সিটিং সার্ভিসের নামে ‘চিটিং’ বন্ধ করার মহান লক্ষ্যেই এতসব কা- করেছেন। এমনটি ভাবলেও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চরণ মনে পড়বে অনিবার্যভাবে, ‘কহিল রাজা, এমনি সব গাধা ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!’

গত কয়েক দিনের রাজধানীর গণপরিবহনের লেজে-গোবরে অবস্থার কারণে গণহয়রানি চরমে পৌঁছেছে। এক সময়ের মুড়ির টিন বলেখ্যাত বাস থেকে রাজধানীর গণপরিবহনের কিছুটা উন্নতি হয়েছে যুগের চাহিদার চাপে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে উত্তরা-মতিঝিল রুটে এসি বাস চালু হওয়ায় রাজধানীর গণপরিবহনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল। অনেক সংগতিসম্পন্ন মানুষও ব্যক্তিগত গাড়ি ছেড়ে পাবলিক বাস নির্ভর হওয়ার প্রবণতায় ঝুঁকেছিলেন। নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন, উত্তরা-মতিঝিল রুটের এ ধারা অন্যান্য রুটেও সম্প্রসারিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং যানজটের কারণে ট্রিপ সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায় উল্লিখিত এসি বাস সার্ভিস ওঠে গেছে। এর পর আরো দুটি প্রতিষ্ঠান এ সার্ভিস চালু করলেও তা শেষতক টেকেনি, ওই একই কারণে।

মনে করা হয়, এর পেছনে মাফিয়া চক্রেরও কারসাজি ছিল। এদিকে পুরো রাজধানী চলে গেছে ব্যক্তি মালিকানার গণপরিবহনের দখলে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নৈরাজ্য। এ নৈরাজ্যের পালকসম একটি দিক হচ্ছে সিটিং সার্ভিসের নামে চিটিং। পরিবহন মালিকদের এ প্রতারণা যখন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল নিরুপায় নগরবাসীর; তখন হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে ক্যানসার-টিউমার অপসারণের মতো কা- করে বসলেন সরকার। বিষয়টিকে ভাবা যায় তালপাতার সিপাহি নিয়ে যুদ্ধে নামার মতো। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে! নগরবাসীর হলো অবাঞ্ছিত ভোগান্তি। পাশাপাশি মূল্য দিতে হলো সরকারকে। উল্লিখিত নৈরাজ্যের জন্য আসলে দায়ী যেই হোক, মানুষ কিন্তু পুরো দায় চাপিয়েছে সরকারের উপরই। এটি আমাদের দেশের বাস্তবতা। আর এ বাস্তবতায় মূল্য দিতে হয় সরকারকেই। জঙ্গি উত্থানের দেশের যে ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে কিন্তু কম ক্ষতি হচ্ছে না রাজধানীর সড়কে যানবাহনের শম্বুক গতিতে। সড়ক পরিবহনের অরাজকতার নেপথ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অদক্ষতা ও অযোগ্যতা। এটি যে কোন পর্যায়ে রয়েছে তা এবার বিআরটিএর চেয়ারম্যানের একটি উক্তিই স্পষ্ট হয়ে গেছে। তিনি ১৮ এপ্রিল বলেছেন, যারা বাস বের না করবে তাদের রুট পারমিট বাতিল করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রুট পারমিটের বিষয়টি বিআরটিএর আওতায় নয়; এটি নগর পুলিশের এখতিয়ারে। আর বিআরটিএর আওতায় যা আছে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে ফিটনেস নির্ধারণ করা। কিন্তু এ কাজটি সরকারি সংস্থাটি কোন মাত্রায় করে তা রাজধানীতে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের দিকে তাকালেই বুঝা যায়।

আর এ দশার পিছনে সরকারি এ সংস্থার লোকেরা লোকচক্ষুর অন্তরালে কি গ্রহণ করেন তা ওপেনসিক্রেট! শুধু তাই নয়, গণপরিবহনের ভাড়ার চার্ট প্রস্তুত করার সময় এমন এক ফর্মেট বিআরটিএ প্রস্তুত করে যা থেকে প্রকৃত চিত্র উদ্ধার কঠিনসাধ্য কাজ। এর উপর আবার ভাড়ার জটিল এ চার্ট প্রকাশ্যে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি অথবা করেনি বিআরটিএ। নিজের সংস্থার এত অদক্ষতার পরও মন্ত্রীর ভুল প্রকাশ্যে সংশোধনের বাহাদুরি করতে মোটেই দ্বিধা করেননি বিআরটিএর গুণধর চেয়ারম্যান মো. মশিউর রহমান।

পরিবহনখাতে অরাজক পরিস্থিতি যখন চরমে তখন সিটিং সার্ভিসের নামে প্রতারণা বন্ধের জন্য ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৮ এপ্রিল যেভাবে প্রকাশ্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন তাতে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ধারা প্রবর্তক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা স্মরণে আসতেই পারে। মধু কবির মেঘনাদবধ কাব্যের একটি চরণ হচ্ছে, ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে!’

সম্ভবত মহাকাব্যের এ বিষাদকেও ছাড়িয়ে গেছে সরকারের ক্ষমতাধর মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উচ্চারণ। পরিবহন মালিকদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে খুবই মাজুল ভঙ্গিতে মন্ত্রী বলেছেন, ‘তারা খুব সামান্য মানুষ নন; তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী। আমরা কি করতে পারি!’

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যখন অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তখন অনেকেই অন্য রকম ভাবেন। অনেকেই মনে করেন, ওবায়দুল কাদের সিনেমার ফাটাকেস্টোর মতো জনপ্রিয় হওয়ার পথে না হেঁটে মন্ত্রীর সীমানার মধ্যে ভূমিকা পালন করলে তাকে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে পথে পথে ছুটতে হতো না; এতটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত না আর পরিবহনখাত। ওবায়দুল কাদের যখন অসহায়ভাবে বলেন, ‘আমরা কি করতে পারি’- তখন কেউ বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিআরটিসি কার্যকর রাখতে পারলে সরকারকে এতটা জিম্মি হতে হতো না।

এ প্রসঙ্গ অনেকেই মন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে চান, রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ সত্ত্বেও বিআরটিসি চিরকালের জন্য রুগ্নই থেকে যাচ্ছে কেন? আরামদায়ক দ্বিতল ভলভো বাস ফানুসের মতো অন্তরালে চলে গেল কার স্বার্থে? বিআরটিসির এসি বাস আন্তঃজেলা রুটে চলার মতো উপযুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও তা চালিয়ে রসাতলে পাঠানোর দায় কার?

সড়ক পরিবহন খাতে মালিকদের প্রভাবশালী হিসেবে আখ্যায়িত করে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অসহায় হয়ে পড়েছেন, দৃশ্যপট এমনই। এ প্রসঙ্গে তাকে বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, নৌ-পরিবহনখাতের মাফিয়া চক্রকে দাপটের সঙ্গে রুখে দেওয়ার একটি ঘটনা। বিএনপি সরকারের সময় তারেক রহমানের বন্ধু হিসেবে পরিচিত গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ছিলেন নৌ-পরিবহনখাতের মাফিয়া চক্রের ডন। তিনি লঞ্চ ধর্মঘটের নামে মন্ত্রী আকবর হোসেনকে জিম্মি করার চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। কারণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর নৌযান নিয়ে মন্ত্রী আকবর হোসেনের প্রস্তুতি ছিল। তিনি ছোটাছুটি না করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবতেন এবং প্রাইভেটখাতের বিকল্প ব্যবস্থা বিবেচনায় রেখেছিলেন।

নৌ-পরিবহনমন্ত্রী আকবর হোসেনকে রাস্তায় ছোটাছুটি বা নদীতে এদিক-ওদিক সাঁতরাতে দেখেননি কেউ । এর পরও তিনি সে সময়ে অঘোষিত যুবরাজের ঘোষিত বন্ধু মামুনের হাইড্রোলিক চাপে বিন্দুমাত্র টলেননি; নৌ-যাত্রীদের কেউ জিম্মিও করতে পারেননি।

সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কোন্ চাপে জিম্মিদশা থেকে সড়ক যাত্রীদের রক্ষা করতে পারছেন না? একি প্রেসার গ্রুপের শক্তির প্রভাব, নাকি অন্য কিছু? এ নিয়ে এখন ভাবছেন অনেকে। বিশেষ করে ১৯ এপ্রিল দুপুরে মন্ত্রীর স্পষ্ট ইঙ্গিত এবং সন্ধ্যায় বৈঠকের পর বিআরটিএর চেয়ারম্যানের সিটিং সার্ভিস বিরোধী অভিযান ১৫ দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণার পর অনেকেই বলছেন, সেই তো নথ খোলালি; তবে কেন লোক হাসালি!

আলম রায়হান : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :