প্রযুক্তির ছোঁয়ায় চাষাবাদে ভাগ্য বদল

মোতাহার হোসেন
 | প্রকাশিত : ২০ এপ্রিল ২০১৭, ১৯:৪৭

‘মাছে ভাতে বাঙ্গালি’ এই প্রবাদটি হাজার বছরের। আর এই মাছ ভাতের যোগান আসে আমাদের কৃষি থেকেই। দিন যত যাচ্ছে ততটাই ভোগবাদী মানুষের চাহিদা বাড়ছে ক্রমাগত। বাড়ছে দেশের জনসংখ্যা, বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য দিন দিন কমছে আবাদি জমি। তবুও আমাদের এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছেন কৃষক। শুধু তাই নয়, চাহিদার উদ্বৃত্ত খাদ্য এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর নেপথ্যে মূলত: দেশে চাষাবাদে আদিম প্রথার বদলে এখন ব্যবহার হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এর ফলে কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেকেলের কাঠের লাঙ্গলের বদলে এখন ব্যবহার হচ্ছে ‘কলের লাঙল’ ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার প্রভৃতি। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফলন বেড়েছে কয়েকগুণ। এ কারণে চাষাবাদে খরচ, শ্রম, সময় সবই কমেছে। আর বাড়ছে ফসল উৎপাদন, বদলাচ্ছে মানুষের ভাগ্যের চাকা, দেখা দিচ্ছে সৌভাগ্যের আলো। কৃষিতে সাম্প্রতিক বিপ্লব, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা বিশ্বখাদ্য সংস্থা এজন্য বাংলাদেশকে পুরস্কৃত করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করর্পোরেশন সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিকাজে সেকেলে যন্ত্রপাতির বদলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। কেবল জমি চাষই নয়, জমিতে নিড়ানি, সার দেওয়া, কীটনাশক ছিটানো, ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও ধান থেকে চালসহ সবই আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের মোট আবাদি জমির ৯০ ভাগ চাষ হচ্ছে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। যতদূর জানা যায়, চীনে ২০২ থেকে ২২০ খ্রিস্টাব্দে মানুষ প্রথম লাঙল ব্যবহার করে জমি চাষ শুরু হয়। কাঠ দিয়ে লাঙল তারাই প্রথম তৈরি করে। লাঙলের ফলা তৈরিতে ব্যবহার করে লৌহদণ্ড। জোয়াল তৈরিতে ব্যবহার করত কাঠ। সেই থেকে কৃষি প্রযুক্তিতে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন কৌশল ও যন্ত্রপাতি, বালইনাশক, সার বীজ প্রভৃতি। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষিতে যে বিপ্লব সাধিত হচ্ছে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা আল্লাহ মুলুম। যাক এনিয়ে কিশোরগঞ্জের মরমি কাব, সাধক ও গীতিকার ইবনে সালেহ মুনতাসির রচিত কৃষিপ্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’ শীর্ষক লিরিকটি যথার্থ বলে মনে হয়। লিরিকটি হচ্ছে: মান্ধাতার আমলের কৃষি চাষাবাদ পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে/ গরুর লাঙ্গল জোয়াল টানার দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে/ গরুর লাঙ্গল জোয়ালের পরিবর্তে আধুনিক যান্ত্রিক চাষাবাদ পদ্ধতি এসেছে/ দোন পদ্ধতিতে কুন উরির পরিবর্তে যান্ত্রিক সেচ পদ্ধতি অনেক আগেই এসেছে। প্রচলিত সাধারণ বীজের পরিবর্তে উফশী হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করা হচ্ছে/খাদ্য উৎপাদন বহুগুণে বেড়েছে/ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে/ সার কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে ফলন অনেক বেড়েছে সময় কম লাগছে/ খাদ্য উৎপাদন মজুদকরণ বাজারজাত করণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গ্রাম আজ আর গ্রাম নেই শহরে পরিণত হয়েছে/ উন্নত যোগযোগ ব্যবস্থায় গ্রামের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে/ আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি বিদ্যুৎ সৌর বিদ্যুৎ গ্রামে গ্রামে পৌঁছেছে/ ফ্রিজ টিভি ইন্টারনেটসহ আধুনিক সকল প্রকার উপকরণ গ্রামে ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশ আজ বিশ্ব নেতৃত্বের কাতারে দাঁড়িয়েছে/ সম্মান আর মর্যাদার বিবেচনায় বিশেষায়িত হয়েছে/ সময়ের পালায় যুগ পরিবর্তনের ঠেলায় ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছে/ পোশাক আর কৃষি শিল্পের উন্নয়নে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের রোল মডেল। বাংলাদেশের উন্নয়নের কাহিনিতো সাধারণের অসাধারণ গল্পের কাহিনী/ সারাবিশ্বের টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে রোল মডেলের যামিনী/ আধুনিক চিন্তাচেতনায় সক্ষমতায় কর্মসংস্থান পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আদরিনী/সাবাস বাংলাদেশ এগিয়ে যাও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই কামিনী। কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে আশির দশকের শুরুতে কৃষিতে ধীরে-ধীরে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ৯/১০ বছর আগে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি বিজ্ঞানীরা কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের কাজ হাতে নেন। বর্তমানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে। লাগসই প্রযুক্তির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কৃষিতে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন সম্ভব। বর্তমানে দেশে যে সব কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে তার অন্যতম হচ্ছে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। এ যন্ত্রের মাধ্যমে ফসল কাটা, খোসা হতে ফসলের দানা আলাদা করার কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া ছোট জমি চাষের জন্য পাওয়ার টিলার, বড় জমি চাষে ট্রাক্টর বা হুইল ট্রাক্টর, বীজ বপন, সার প্রয়োগ ও কীটনাশক ছিটানোর জন্য ব্রডকাস্ট সিডার, নির্দিষ্ট অবস্থানে বীজ বপনের জন্য সিড ড্রিল, গভীরভাবে কঠিন স্তরের মাটি কর্ষণের জন্য সাব ব্রয়লার, ধান/বীজ শুকানোর যন্ত্র ‘ড্রায়ার’, ধান, গম, ভুট্টা শুকানোর যন্ত্র ব্যাচ ড্রায়ার, পাওয়ার রিপার মেশিন (শস্য কাটার যন্ত্র), ঝাড়ার যন্ত্র ইউনারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চাষাবাদে ব্যবহার হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাওয়ার টিলার, পাওয়ার রিপার, ঝাড়ার যন্ত্র ইউনার, নিড়ানির যন্ত্র ইউডার, ধান ও গম মাড়াই কল, ভুট্টা মাড়াই কল ইত্যাদি যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, যশোর, শেরপুরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সেচপাম্প, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের খুচরা যন্ত্রপাতি তৈরির বেশকিছু কারখানা গড়ে উঠেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। চাষাবাদে কাঠের লাঙ্গলের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। কৃষি কাজের মধ্যে সবচেয়ে শ্রমনির্ভর কাজ হচ্ছে বীজ বা চারা রোপণ, আগাছা দমন ও ফসল কাটা। মৌসুমের নির্দিষ্ট সময়ে বীজ বপন, চারা রোপণ এবং ফসল কেটে ঘরে তুলতে কৃষককে বেশ সংকটে পড়তে হয়। ওই সময়ে কৃষি শ্রমিকের মজুরি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কখনো কখনো দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। ফলে বিলম্বে বীজ রোপণের জন্য ফলন কম হয়, পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পায়।

তিনি বলেন, কখনো কখনো বিলম্বে ফসল কাটা ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে উৎপাদিত শস্যের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া আগাম ফসল বিক্রি করতে না পারার কারণে প্রত্যাশিত মূল্য থেকেও কৃষক বঞ্চিত হন। এসব থেকে রক্ষা পেতেই কৃষি কাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে যেমন সময় কম লাগছে, তেমনি বেশি ফসলও উৎপাদন হচ্ছে। কৃষক দিয়ে এক বিঘা জমির ধান কাটাতে খরচ হয় তিন হাজার টাকা। আর ‘রিপার’ দিয়ে ধান কাটতে বিঘা প্রতি খরচ হয় মাত্র ৫০০ টাকা। সময়ও লাগে কম। গরু দিয়ে হালচাষ করতে বিঘা প্রতি খরচ হয় ৭০০ টাকা। আর পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ করতে খরচ হয় প্রতি বিঘায় ৪০০ টাকা। ট্রাক্টর দিয়ে হয় মাত্র ২৫০ টাকা। তাই তারা এসব আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন। তবে এসব যন্ত্রপাতির দাম কমানো দরকার।

কৃষিবিজ্ঞানী ড. রাশিদ উল হক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রায় ১৫ শতাংশ খাদ্যশস্য বিনষ্ট হয়, যার পরিমাণ ৪৩ লাখ টন। অথচ চাষাবাদে পুরোপুরি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এসব সমস্যা দূর করা সম্ভব বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক রফিকুল ইসলাম মণ্ডল এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে ইনস্টিটিউটের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ প্রতিনিয়ত কাজ করছে। বারি উদ্ভাবিত ‘পাওয়ার টিলার অপারেটেড সিডার’-এর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এই যন্ত্রটি দিয়ে একইসাথে জমি চাষ, জমি লেভেল, সার ও বীজ দেয়া যায়। দিন দিন আমাদের জমি কমে যাচ্ছে, কিন্তু খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। তাই কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে চাষাবাদের সব পর্যায়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেন তিনি। তবে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও উন্নতি সাধিত হয়েছে তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দেশের তৃণমূলে এই খাতে জড়িত কৃষক, তরুণ উদ্যোক্তাদের এ প্রযুক্তি সম্পর্কে আপডেট ধারনা দেয়ার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মাঠ পর্যায়ে সমন্বিত ভাবে কাজ করবেন। আর এর তদারকি করতে হবে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট উইংকে। এ ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান কৃষকদের পাশে থেকে প্রযুক্তিগত ধারণা প্রদান, প্রশিক্ষণ, পরার্মশ ও কৌশলগত সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন এই প্রত্যাশা থাকল।

মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

[email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :