মেরামত না করে, নতুন বাস কেনায় এত আগ্রহ কেন?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২০ এপ্রিল ২০১৭, ২২:০৩

১৯৯৯ সালে কেনা সাদা ডাবলডেকার বাসগুলোর কথা মনে আছে? সুইডেন থেকে আনা হয়েছিল। কষ্টের ঢাকা শহরে স্বস্তির আবহ নিয়ে নগরে নেমেছিল সুইডেন থেকে কেনা ৫০টি বাস। ভারত কিংবা চীনে তৈরি বাসের তুলনায় সেই বাসগুলোর বডি ছিল অনেক উন্নতমানের। সিট, ইঞ্জিন ও বাহ্যিক সৌন্দর্যসহ প্রতিটি মানদণ্ডে ভলভো বাসগুলো নগরবাসীর মন জয় কেড়েছিল। সর্বশেষ খবর পর্যন্ত, ৫০ টি বাস এর মধ্যে এখন রাস্তায় কোনমতে চলছে দুটি বাস!

আবার ২০১২ সালে রাজধানীতে নামানো হয়েছিল ৫০টি জোড়া বাস। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী এগুলোর ১৪টিই অচল হয়ে গেছে; ১৬টি অচল হওয়ার পথে! জনগণের টাকায় কেনা গাড়ি একবার স্টার্ট বন্ধ হলে আর চালু হয়না, অন্যদিকে বেসরকারি মালিকানাধীন বাসগুলোর অধিকাংশই ২০-২৫ বছর পুরনো! তাহলে রহস্যটা কোথায়? জনগণের টাকায় কেনা ডাবল ডেকার কিংবা জোড়াবাস নষ্ট হয়ে পড়ে থাকলে বা মেরামত না করা হলে লাভ কার?

জনমনে প্রশ্ন, সন্দেহ। বাসগুলো একবার নষ্ট হলে বা সমস্যা দেখা দিলে আর মেরামত করা হয়না কেন? সাধারণ একটা ধারণা আছে, বেসরকারি মালিকদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে সরকারি অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মেরামতযোগ্য বাস আর মেরামত করার উদ্যোগ নেয়না। ডাবল ডেকার কিংবা জোড়া বাসে যাত্রীধরে অনেক বেশী। এতে করে কম মুনাফা হয় বেসরকারি বাস মালিকদের। এরা নাকি দেশের রেল ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রন করে।

সকালের ট্রেনগুলোকে ইচ্ছে করে ছাড়া হয়না, অথবা অফিস টাইমের পরে ছাড়া হয়।গাজীপুর, উত্তরা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি কাছের দূরত্ব থেকে আসা-যাওয়া করা ট্রেনগুলো নিয়ে এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন অসাধু সিন্ডিকেট তৈরি করে জনদুর্ভোগ না ঘটাতে পারে, সেদিকে নজর রাখার দায়িত্ব মন্ত্রী, এমপি ও অন্যান্য দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের। সংবাদমাধ্যমগুলো যতটুকু পারে নিউজ করে রাষ্ট্র এবং সরকারকে সচেতন রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের খবরে যদি কর্তৃপক্ষের টনক না নড়ে তাহলে পরিবর্তন আনা অসম্ভব।

১৯৯৯ সালে দোতলা ভলভো বাস কেনার প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। বছরে সাত লাখ ২০ হাজার যাত্রী আনা-নেয়া করা যাবে এমন একটা টার্গেট ঠিক করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিটি বাস এক কোটি তিন লাখ টাকা দরে ডাবল ডেকার বাসগুলো কিনেছিল। উদ্দেশ্য ছিল ছোট ছোট মিনিবাসের কনসেপ্ট থেকে বেরিয়ে এসে বড় বড় বাসসেবা চালু করা।

মিনিবাসগুলো রাস্তায় জায়গা দখল করে বেশী, একেকটি বাসে যাত্রী ধরে মোটে ২৮ জন। ‘মতিঝিল ৬ বনানী’ টাইপের বাসে যাত্রী ধরে ৫০-৬০ জন। অন্যদিকে একেকটি ভলভো বাসে যাত্রী ধরত ১২০ জন, এছাড়া দাঁড়িয়ে থাকলে অতিরিক্ত যাত্রী ধরত আরও ৫০ জন। একটা দোতলা বাস ৬ টি মিনিবাসের সমান সার্ভিস দিতে পারে। এমন ভালো সরকারি সার্ভিস সহ্য হবে কেন মুনাফালোভী মালিকদের সহ্য হবে? ধারণা করা যায় যে, বাসগুলো জনপ্রিয় হওয়ায় বেসরকারি বাস মালিকদের চক্ষুশুল হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলাফলস্বরূপ, ভলভো বাসে একটু সমস্যা দেখা দিলেই ফেলে রাখা শুরু হয় মিরপুর ও অন্যান্য বাস ডিপোতে।

রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বরে বিআরটিসির ডিপোয় ২৪টি ও গাজীপুরে বিআরটিসির সমন্বিত কেন্দ্রীয় বাস মেরামত কারখানায় ২৪টি ভলভো বাস পড়ে আছে অযত্নে। বিআরটিসি সূত্রে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছিল যে, এক কোটি তিন লাখ টাকা দাম পড়েছিল একেকটি বাসের। মেরামত করতে প্রতিটির পেছনে খরচ পড়বে গড়ে ৩৫ লাখ থেকে ৪২ লাখ টাকা। কিন্তু তার অর্থ মিলছে না ১০ বছর ধরে।

ভলভো বাস কেনার প্রকল্পে সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (সিডা) ৬১ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছিল। সংস্থাটি ৩০ দশমিক ৫ কোটি টাকা ঋণ দেয় এবং ৩০ দশমিক ৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল। ৫০টি বাস কেনার পর বেঁচে গিয়েছিল প্রায় ৯ কোটি টাকা।

নানা ছুতায় ভলভো বাসগুলোকে ডিপোতে ফেলে রাখা শুরু হল। এখন ৫০টির মধ্যে মাত্র দুইটা চলাচল করে। তবে ইচ্ছে করেই যেন মেরামত করা হয়না এগুলোরও। সরকারি বাস সার্ভিসে সংকট সৃষ্টি হলে তোরজোড় শুরু হয় নতুন বাস কেনার। কেনার দিকে দারুণ আগ্রহ সংশ্লিষ্ট সকলের। অনেক ঢাকঢোল বাজিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০১২ সালে রাজধানীতে নামাল ৫০টি জোড়া বাস। কিন্তু বাসগুলো এতটাই নিম্নমানের যে ইতোমধ্যেই ১৪টিই অচল হয়ে গেছে; ১৬টি অচল হওয়ার উপক্রম।

মাত্রই ২/৩ বছর আগে কেনা বিআরটিসি বাসগুলোর দিকে তাকানো যায়না। কোটি কোটি টাকা খরচ করে এত কম সময়ের জন্য বাস কেনার কী মানে আছে? জনগণের করের টাকায় দেশ চলে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। জনগণের কোটি কোটি টাকায় নিম্নমানের বাস কিনে কয়দিন পর আবার ফেলে দেয়ার বিলাসিতা করার দিন শেষ হবে কবে?

এর মধ্যেই শোনা যাচ্ছে, সরকার নতুন করে আবার বাস কিনবে। পুরনো বাসগুলো মেরামত না করে, এভাবে ফেলে রেখে, নতুন বাস কিনলে আদৌ কি দীর্ঘমেয়াদে কোনো লাভ হবে জাতির? নতুন কেনা বাসগুলো যে নিম্নমানের হবেনা তার নিশ্চয়তা জনগণ কোথায় পাবে?

গত ৪/৫ দিন ঢাকার মানুষ যেভাবে অমানবিক কষ্ট করেছে তাতে সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে না বেড়েছে? মানুষকে জিম্মি করে বাস মালিকরা ঠিকই সিটিং সার্ভিস আবার চালু করে নিয়েছে। মাঝখান দিয়ে বেড়েছে লোকাল বাসের ভাড়াও। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের। দেশের মানুষ দেখল বাস মালিকদের কাছে রাষ্ট্র অসহায়। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা দেখল, সরকার পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে পারছেনা। এতে করে মানুষের ভেতরে নিঃসন্দেহে হতাশা বাড়বে।

অথচ গত ৮ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক অর্জন আছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে মামলা লড়ে বিশাল সমুদ্র সীমা বিজয়, দারিদ্র হার কমানো, জেন্ডার প্যারিটি এবং পিস ইনডেক্সে ভারত-পাকিস্তানকে বহু পেছনে ফেলা, প্রবৃদ্ধির হার নিয়মিত ভাবে সাতে রাখা ইত্যাদি নানাবিধ অগ্রগতি এ সরকারের আছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমান সরকার বিরাট অগ্রগতি অর্জন করেছে। ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। বিএনপি আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল মোটে ৩৩০০ মেগাওয়াট। জঙ্গিদমনে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য রয়েছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা থাকলেও জনগণ উন্নয়নের রাজনীতি মেনে নিয়েছে। বিরোধী বিএনপি-জামাত জোট বহু চেষ্টা করেও কার্যকর কিছু করতে পারছেনা। জনগণ আওয়ামী লীগ সরকারকে গ্রহণ করেছে বলেই মনে হয়। এখন সরকারের মন্ত্রী-আমলারা যদি নিজেরাই জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করেন তাহলে নিকট অতীতের সাফল্য মানুষ মনে রাখবেনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই সব দিক সামলাবেন আর বাকিরা একটার পর একটা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবেন, এমন চলতে পারেনা। কার্যকর সরকারব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা দিয়েই কায়েম করতে হবে।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :