বানে ভাসা হাওরের হালচাল

প্রকাশ | ২১ এপ্রিল ২০১৭, ১১:৫৫

অনুপম মাহমুদ

উজানের ঢলে এবারো তলিয়ে গেছে হাওরের ফসল, এই তথ্য ইতিমধ্যে দেশবাসী অবগত হয়েছেন। কৃষকের চোখের নোনাজলে হয়তো একটু হলেও বেড়েছে হাওর এলাকার পানির উচ্চতা। ইতিমধ্যে হাওরের ক্ষতিগ্রস্থ্য এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছেন আমাদের হাওরের ভূমিপূত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ। তিনি ইতিমধ্যে কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ এর জলমগ্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।  

এরই মধ্যে খবর এসেছে নেত্রকোনার হাওরে ভেসে উঠেছে হাওরের মাছ। অসময়ের পানি গ্রাস করেছে জমির ফসল, আর সেই ফসল পানির নিচে থাকায় পচে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে আর যাথে যুক্ত হয়েছে বৈশাখের প্রচন্ড উত্তাপ। এতে অক্সিজেন এর স্বল্পতায় মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। ফসল হানির পর প্রকৃতির দান মৎস্য সম্পদের এই করুন দশায় কৃষক ও মৌসুমী জেলেদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ স্পষ্ট।
হাওর এলাকার পেশা মূলত দুইটি, (১) কৃষি ও (২) মৎস্য আহরন। এই বছর হাওর এর মুখ্য দুইটি সম্পদ হারিয়ে যে ক্ষতির সম্মূখীন হয়েছেন তা নিকট অতীতে আর দেখা যায়নি। ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় উন্নয়নকর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধী বৃন্দ সুনামগঞ্জ কে ও কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জনাব রেজয়ান আহমেদ তৌফিক সংবাদ সম্মেলন করে হাওর এলাকারে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষন করেছে। শুধু তাই নয় সুনামগঞ্জে হাওরের এর দুর্দশাকে মাথায় রেখে বৈশখ তথা নববর্ষ উদযাপনের সকল আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করা হয়েছে। শুধু তাই নয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতির প্রতিবাদে তারা দফায় দফায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। এরই মধ্যে দুদক এর নেতৃতে এই দুর্নীতির অনুসন্ধানে একটি টিম মাঠে নেমেছে। পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

আবার দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় সচিব মহোদয় সুনামগঞ্জের একটি সভায় বলেছেন, “একটা ছাগলও মারা যায় কিসের দুর্যোগ?” এই বক্ত্যবে হাওর বাসীদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। হাওর বাসীরা অকাল এই বন্যার প্রকৃত কারন অনুসন্ধান করে এর সুষ্ঠু সমাধান প্রত্যাশা করছেন।

হাওর এলাকার নদী, নালা, খাল বিল, ডোবা ও জলাশয় বছরের পর পর উজান থেকে নেমে আসা পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়া অন্যতম কারন হিসেবে চিহ্নিত করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ক্যাপিটেল ড্রেজিং এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এর পাশাপাশি দেশ বরেন্য পানি বিষেষজ্ঞ্য অধ্যাপক আইনুল নিশাত এই বিপর্যয়কে জলবায়ু পরিবর্তন কে দায়ী করেছেন। এর জন্য আমাদের প্রস্তত না থাকা ও হাওর এর কৃষি ব্যবস্থাপনার সংস্কার কে গুরুত্ব্য আরোপ করতে বলা হয়েছে।

গত শতাব্দীর সত্তর এর দশকে হাওর এলাকায় বোরো চাষ শুরু হয়েছে, সে সময় বন্যা আসতো এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসের শেষের দিকে, কিন্তু এখন পানি আগাম চলে আসছে। এমনকি এটা মার্চ মাসের শুরুতেই চলে আসতে পারে। তাই প্রকৃতির এই পরিবর্তন কে মাথ্য রেখে কম সময় লাগে এমন ধান হাওর এলাকায় চাষাবাদ করতে হবে। রবি শষ্য অথবা বোরো চাষ যেকোন একটা এখন হয়তো এই হাওর বাসীকে বিসর্জন দিতে হবে, তা না হলে হাওরের এই বিপর্যয় রোধ করা অসম্ভব।

হাওর এর বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড এর উদাসীনিতা ও ঠিকাদারদের সীমাহীন দুর্নীতি এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারন হিসেবে এইবার বেশ জোরেসোরেই শুনা যাচ্ছে, হাওরবাসী এইবার এই দুর্নীতির বিচার চাইতে সোচ্চার। এই অনাচার এখনই বন্ধ না হলে বা প্রতিকার না হলে যে কোন সময় একটি গণবিক্ষোভ এর সূত্রপাত হতে পারে। শান্ত হাওরে এই ক্ষোভের প্রশমনে রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে এখনি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সচেতন হাওরবাসী আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে।

গত ১৫ এপ্রিল ২০১৭ কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়ন এর হাওরে ভুট্টা নিয়ে ফেরার পথে নৌকা ডুবে একজন নিখোঁজ আছেন। এর পাশাপাশি সিংপুর ও ছাতিরচরে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙ্গন। গতকালের কালবৈশাখী ঝড় ও অঝর বৃষ্টিপাতে হাওরে পানি আরো বৃদ্ধি পাওয়ায় দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের সংকট। এমতাবস্থায় হাওর বাসী মানবেতর জীবন জাপন করছেন।

হাওর একটি ব্যাতিক্রম ধর্মী এলাকা, বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল থেকে ভিন্ন এই এলাকার জীবন যাপন, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও বিশেষত কৃষি। তাই জলবায়ু পরিবর্তন কে মাথ্য রেখে এই এলাকার জন্য করনীয় নির্ধারণে অনতিবিলম্বে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করে করনীয় নির্ধারণ করা অতীব জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষ (যে প্রতিষ্ঠান টি কাজ করে উত্তর বঙ্গ এলাকার জন্য) এর অনুরুপ একটি শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ গঠন করে হাওর এলাকার উন্নয়ন নিশ্চিত করন এখন সময়ের দাবী।

অনুপম মাহমুদ : উন্নয়ন ও অধিকারকর্মী

ঢাকাটাইমস/২১এপ্রিল/এএম/টিএমএইচ