‘মাস্টার প্ল্যান’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা

প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:১৪ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৭, ১১:০৫

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস

চট্টগ্রাম মহানগরীর দুই যুগ ধরে চলা জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সময় খরচ হয়েছে শত শত কোটি টাকা।  কিন্তু ফল আসেনি। দিনের পর দিন বাড়ছে জলাবদ্ধতা সমস্যা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ঘণ্টাকালের বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় মহানগরীর অনেক সড়ক।

সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নগরীর মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে নগরীর সড়ক ও নালানর্দমা সংস্কারে নগরীর মানুষ জলাবদ্ধতা নিরসনে যে আশার আলো দেখেছিল, তা এখন হতাশার দিকে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করে জানান, জলাবদ্ধতা সমস্যা উত্তারিধকার সূত্রে পাওয়া। তিনি গত দেড় বছরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সড়কের উন্নয়ন ও নালানর্দমা সংস্কারের ফলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাওয়ার কথাও বলেন। তবে নগরীর জলাবদ্ধতা রোধে তিনি এ সময় মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।

মেয়র আরো জানান, চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্ণফুলী নদীর তীরে দেয়াল নির্মাণ, ২৫টি খাল ড্রেজিং এবং খালের মুখে পা¤প হাউসসহ স্লুইচ গেট নির্মাণের জন্য ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতা আরো কমবে।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় সড়কের উন্নয়ন ও নালানর্দমা পরিষ্কার করায় এবার জলাবদ্ধতা কম হয়েছে। এ এলাকায় ফরিদের পাড়া সড়কের কাজ শেষ হলে আর জলাবদ্ধতা হবে না। তবে মুরাদপুর থেকে চান্দগাঁও সমশেরপাড়া পর্যন্ত সাত কিলোমিটার খাল খনন করতে হবে।

এভাবে চকবাজার এলাকার কাপাসগোলা ও বাঁদুড়তলা এলাকায়ও জলাবদ্ধতা কমেছে। বাকলিয়া, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জেও পানি তুলনামূলক কম জমেছে। আবার কম সময়ে পানি নেমেও গেছে। এসব এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গত দেড় বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় শত কোটি টাকার কাজ করা হয়েছে বলে সূত্র জানায়।

সূত্র জানায়, সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী তার ক্ষমতার ১৭ বছর মেয়াদে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয় করেন ৮০ কোটি টাকা। পরবর্তী মেয়র এম মনজুর আলম তার পাঁচ বছরে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, খাল খনন, নালানর্দমা পরিষ্কারসহ বিভিন্ন খাতে খরচ করেন ২১২ কোটি টাকা। জলাবদ্ধতার পেছনে গত ২২ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা খরচ হলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়নি নগরী।

এ ব্যাপারে কথা হয় সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০ বছর আগে নেয়া হয়েছিল স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্লাড কন্ট্রোল মাস্টার প্ল্যান। পাঁচ পর্বে বাস্তবায়নের এই প্রকল্পের  একটি পর্ব কোনো রকমভাবে শেষ হয়েছে। কাগুজে পরিকল্পনার প্রথম ধাপটি শেষ হয়েছে। বাকি চার ধাপের বাস্তবায়নের কোনো রোডম্যাপ নেই। ২০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে মাস্টার প্ল্যান। ফলে গত ২২ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা জলাবদ্ধতার পেছনে ব্যয় হলেও বাস্তবে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি তেমন।  

অপরিকল্পিত নগরায়ণকেও অনেকে জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ কোনো গবেষণা ছাড়াই চসিক খাল সংস্কার কাজে পানিতে টাকা ঢালছে। আর চউক প্রতিদিনই অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘরের নকশা অনুমোদন দিচ্ছে। ড্রেনেজ নিয়ে নেই কোনো ভাবনা। দুই যুগ ধরে দফায় দফায় পরিকল্পনাতেই সব সীমাবদ্ধ।

গত ছয় বছরে চউক প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চসিকও বিভিন্ন খাতে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু এর কোনো সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী। বরং উল্টো এখন দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কোনো কোনো প্রকল্প। এ নিয়ে চসিক ও চউকের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথাও বলছেন অনেকে। দুই সংস্থার কার্যক্রম ও পরিকল্পনা গ্রহণে সমন্বয়ের অভাব। চসিক জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সচল রাখতে সংস্কার ও নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জনসংখ্যার চাপ বা নগরায়ণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগরীর কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেন, চউক শুধু রাস্তা নির্মাণ বা আবাসিক এলাকা তৈরিতেই ব্যস্ত। ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পও গ্রহণ করা হয় সম্ভাব্যতা জরিপ ছাড়া। চউকের অনেক প্রকল্প জলাবদ্ধতার কারণ হচ্ছে। ফ্লাইওভারের কারণে পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় শুক্রবার তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম মাস্টার প্ল্যান বা মহাপরিকল্পনার কথা সামনে আনেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরের উন্নয়নে ১৯৯৫ সালে গৃহীত মহাপরিকল্পনা অনুসরণ করা হয়নি। সেই মহাপরিকল্পনায় জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খনন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়ার সু¯পষ্ট সুপারিশ ছিল। তা না মেনে অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করায় চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এখন বৃষ্টি না হলেও জোয়ারের পানিতে এ শহর দিনে দুবার ডোবে।

১৯৯৫ সালের মহাপরিকল্পনায় নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে একাধিক খাল খননের কথা বলা হয়েছিল। সেসব খাল কে কোনটা খনন করবে, তার খরচ কত পড়বে- সবই লেখা ছিল পরিকল্পনায়। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেই সময় তা বাস্তবায়ন করেনি। তাই এত দিন পর চট্টগ্রামে নতুন করে খাল খনন জরুরি হয়ে পড়েছে।

কর্ণফুলী নদীর ওপর পিলার সেতু নির্মাণকেও জলাবদ্ধতা সমস্যার একটা কারণ হিসেবে দেখছেন আবদুচ ছালাম। তিনি বলেন, ‘ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের দাবিতে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। সেদিন বিএনপি সরকার ইগোর বশবর্তী হয়ে পিলার সেতু নির্মাণ করেছিল। এ পিলার সেতু নির্মাণের মাধ্যমে কর্ণফুলীকে ধ্বংস করা হয়েছে।’ চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে কোনো গবেষণা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

(ঢাকাটাইমস/২৩এপ্রিল/মোআ)