মেয়র সাহেবদের নাকে কি একটু গন্ধও লাগে না?

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১০:৪৬ | প্রকাশিত : ২৩ এপ্রিল ২০১৭, ২৩:০৩

সায়েন্সল্যাব ওভারব্রিজের এলিফ্যান্টরোড-মুখী প্রান্তে সিঁড়ির নিচে বা পাশে কি কখনো আমাদের মেয়রসাহেবরা খানিকক্ষণের জন্য দাঁড়িয়েছেন? দাঁড়ানো বাদ দিলাম। কখনো হেঁটে গেছেন এর পাশ দিয়ে? যাননি নিশ্চিত। না হলে এভাবে মানুষকে এখানে মল-মূত্র ত্যাগ করতে হয়তো দিতেন না। যারা প্রতিদিন ওভারব্রিজে উঠানামা করেন কিংবা অফিস-দোকানে আসা-যাওয়া করেন তারা চেপে চেপে নাক ব্যথা করে ফেলেন। কিন্তু গন্ধ নতুন হয় প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। যারা খোলা রাস্তায় এভাবে পেশাব-পায়খানা করেন, তাদের লজ্জা হয়না। লজ্জা পাই আমরা পথচারীরা। মেয়র সাহেবরাও কি একটু লজ্জিত হবেন?

সায়েন্স ল্যাবরেটরির মূল ফটক থেকে একটু সামনে একটা বড় ডাস্টবিন খোলা অবস্থায় রয়েছে বহুদিন ধরে। কতশত শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ এর সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করেন প্রতিদিন। ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলে যায়। মানুষ শপিং এ আসে হাজারে হাজারে। কিন্তু এই ডাস্টবিন দিনে দিনে যেন ভাগাড়ের রূপ ধারণ করেছে। বিকট গন্ধে পেট ফুলে যাওয়ার দশা হয় প্রতিদিন। দেখার এবং গন্ধ সহ্য করার মানুষ আছে কত! যাদের এই ডাস্টবিন সরানোর কথা তাদের কোন কর্মকাণ্ড নাই। নিউমার্কেট-গাউছিয়া সংলগ্ন ওভারব্রিজের পাশে প্রতিদিন দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা জমা হয়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। হাজার হাজার নর-নারী-শিশু আসেন। এত বড় একটা মার্কেট প্লেসের ময়লা খোলা রাস্তায় পড়ে থাকে।

পরিবাগ নামের ভিআইপি স্থানে সব বড় বড় সরকারি মন্ত্রী-আমলার বসবাস। সেখানে বিটিসিএল অফিসের আগে ৪/৫টা বিশাল বিশাল ডাস্টবিনে প্রতিদিন নতুন করে ময়লা জমায় লোকজন। এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই। কী নির্মম আচরণ সিটি কর্পোরেশনের!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ আগের পিজি নামের হাসপাতালের মূলফটক সংলগ্ন ওভারব্রিজের একপাশের সিঁড়ির নিচের অংশের অবস্থা একইরকম। দেশের একমাত্র মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মানুষ এভাবে মল-মূত্র ত্যাগ করতে পারে তা দেখলে নিজের জাতিকে খুব নোংরা বলে মনে হয়।

রূপসী বাংলা হোটেল মোড়ের সাকুরার উল্টা পাশে রাস্তা পার হয়ে আসার সময় দুটি বড় বড় গাছের জন্য ফুটপাথ বানানো যায়না। কিন্তু গাছের আড়াল থেকে কী যে বিকট গন্ধ আসে তা আমাদের কাচের ঘরে থাকা মেয়র সাহেবদের বুঝানো যাবেনা। দুইমাস ধরে দেখছি, ফুটপাত সংস্কারের কাজ চলছে। টাইলস লাগানো শেষ হয়না। একবার লাগায়, আবার খুলে। গাছ দুটি রেখে দিয়ে মেয়র সাহেবরা কী প্রমাণ করতে চাইছেন বোধগম্য নয়।

এরকম অনেক ডাস্টবিন, খোলা পেশাব-পায়খানার জায়গার নাম বলা যাবে। বিকট গন্ধের বিশ্রী বর্ণনাও দেয়া যাবে। কিন্তু লেখা শেষ হবেনা। ধানমণ্ডি রাসেল স্কয়ার থেকে ল্যাব এইড এর সামনে আসতে এমন কিছু বড় ডাস্টবিন , ময়লা, ময়লা খাওয়া কাক এগুলো মানুষকে সহ্য করতে হয়। ট্রাফিকে আটকে গিয়ে কারো যদি ডাস্টবিন বরাবর অপেক্ষা করতে হয় তাহলে পেট ফেটে যাওয়ার দশা হয়। মেয়র সাহেবদের হয়তো এই অভিজ্ঞতা নেই। তাই গন্ধ কত প্রকার, কি কি তাদের বোধগম্য হবেনা।

এত আয়োজন, এত আলোচনা-সমালোচনার ভেলায় ভেসে আপনারা মেয়র হলেন। এই বড় বড় ডাস্টবিনগুলো কবে সরাতে পারবেন বলে আপনাদের মনে হয়। কত বছর ধরে এই ডাস্টবিনগুলো নগরীর রাস্তায় খোলা পড়ে আছে সেটা কি আপনারা হিসেব করে বলতে পারবেন? মনে হয়না। বা কতদিন এভাবে আমাদের নাক চেপে চলাফেরা করতে হবে, সেটা কি একটু ভেবে বলতে পারবেন?

মাঝে মাঝে আপনাদের দেখা যায়, সংবাদ সম্মেলন করছেন। হাতে বাহারি ঝাড়ু নিয়ে, কোদাল দিয়ে একটু ময়লা সাফ করে মিডিয়ার কাভারেজ পাচ্ছেন। কী আজব মিডিয়া আমাদের! মিডিয়ার মানুষগুলোর নাকেও কি বিকট গন্ধ একটু লাগেনা। আপনারা যে কিছু করছেন না, সেটা আমরা বলছিনা। হকার উঠিয়ে দিয়ে গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম সাফ করছেন। যদিও হাজার হাজার গরীব হকারদের পুনর্বাসন কল্পে কিছুই করা হয়নি। ফলে কয়দিন এভাবে জোর করে ফুটপাত পরিষ্কার রাখতে পারবেন এতে জনমনে সংশয় আছে। ছোট ছোট বিন বানিয়ে মেয়র সাহেবরা নিজেদের নাম ছাপিয়ে টাঙ্গিয়ে দিয়েছেন নগরীর বিভিন্ন স্থানে। মানুষ আসা-যাওয়ার পথে হাতের ময়লা এসব বিনে রাখতে শিখছে।

চায়ের বা কফির ওয়ানটাইম কাপ, কোক/পেপসির বোতল, মুড়ি/চিড়া ভাজার ঠোংগা, চিপসের প্যাকেট জাতীয় ময়লা মানুষ এসব বিনে ফেলছে। এটা নগরীর মানুষকে নতুন করে কিছু শেখাচ্ছে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু খোলা ডাস্টবিন সরাতে না পারলে এই ছোট ছোট বিন রেখে আদতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয়না। মেয়র সাহেবরা তো নিজেদের নামযুক্ত বিন বানিয়ে দিয়েছেন বিরাট কাজ করেছেন ভেবে তৃপ্তি পাচ্ছেন। কিন্তু এসব বিনে মানুষ কী ময়লা ফেলছে, কতখানি ময়লা ফেলছে কিংবা এই বিনগুলো থেকে কারা ময়লা নিয়ে খালি করছে-এর খবর কি আমাদের নগরপিতারা নিয়েছেন? প্রায়শই দেখি টোকাই ছেলে-মেয়েরা এই বিনগুলো খালি করে ময়লাগুলো নিয়ে যাচ্ছে। খুব সকালে যদি মেয়র সাহেবরা গাড়ি নিয়ে ঢাকায় ঘুরতে বের হন তাহলে এই দৃশ্য দেখতে পারবেন। অথবা গভীর রাতেও বের হতে পারেন। অথচ মেয়রদের নামযুক্ত এই বিনগুলো থেকে ময়লা সাফ করার দায়িত্ব কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর।

উত্তরের মেয়র আনিসুল হক সাহেব একজন জাত ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরাই ইদানিং জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন। আওয়ামের এতে কিছু করার নেই। যার টাকা বেশী, সেই এখন বড় নেতা। ইন্টারেস্টিং রসায়ন রাজনীতির। মেয়র আনিসুল হক এর একটা সুবিধা হল উনার চলাফেরা কিংবা কাজের এলাকা খুব অভিজাত মানুষদের নিয়ে। যদিও কড়াইল বস্তির মত বড় একটা জায়গাও তাঁর এলাকায় পড়েছে। তবে কড়াইল বস্তি নিয়ে তাঁকে কিছু করতে দেখা যায়না। তবে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সরিয়ে উনি যা করেছেন সেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। দূতাবাসগুলোর দখল করে রাখা ফুটপাত উদ্ধার করেও তিনি বেশ কাজের কাজ করছেন। কিন্তু গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরা এগুলোই পুরো ঢাকা না। দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন এর ঝামেলা এবং চ্যালেঞ্জ অনেক বেশী। হকারদের সামলাতে হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু হকাররাই একমাত্র সমস্যা বা টার্গেট হতে পারেনা। আরও অনেক সংকট আছে। এর মধ্যে প্রধান দুটি হল ময়লা আবর্জনা এবং ট্রাফিক ও গণপরিবহন। একদিকে মানুষ বাড়ছে প্রতিদিন, সে তুলনায় অনেক কম পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। মেট্রো রেল হচ্ছে। অনেকগুলো ফ্লাইওভার হচ্ছে। মানুষ অপেক্ষা করে আছে কবে এগুলো নির্মিত হবে। কিন্তু এর জন্য মানুষকে যে পরিমাণ কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে সেটাও অনেক বড় একটা ইস্যু। মৌচাক-মালিবাগ এলাকার অবস্থা খুব খারাপ। মানুষ শুধু কষ্ট করছে তা নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাচ্ছে। সেখানকার দোকানগুলো গ্রাহক হারাচ্ছে প্রতিদিন। কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দোকান মালিকরা। বেকার হয়ে যাচ্ছে গরীব মানুষগুলো। অথচ ফ্লাইওভারগুলোর বাজেট খালি বাড়ছে। প্রলম্বিত হচ্ছে নির্মাণকাল। কষ্ট বাড়ছে মানুষের।

যাইহোক, ময়লা-আবর্জনা-গন্ধের কথায় ফিরে আসি। আর কত হাজার কোটি টাকা খরচ করলে ঢাকার ময়লা আবর্জনার একটা বিহিত করতে পারবেন আমাদের নগরপিতারা? ঢাকার ময়লা কোনমতে নিয়ে সাভার, আশুলিয়ায় ফেলে দিয়ে আসা হচ্ছে। সাভার-ঢাকা আসা-যাওয়ার পথে কত ধরনের দম বন্ধ হওয়া গন্ধ আমাদের সহ্য করতে হয় তা যদি আমাদের রাষ্ট্রীয় অভিভাবকরা জানতেন! গন্ধ এত পচা হতে পারে তা নাকে এসে ধাক্কা না দিলে কেউ বুঝবেনা। আশুলিয়া ব্রিজের আগে, কিংবা পিএটিসির সামনে খোলা রাস্তায় পড়ে আছে ময়লা। যারা এসি গাড়ি দিয়ে চলাফেরা করেন তাদের কষ্ট কম। ময়লার স্তূপ থেকে উঠা ধোঁয়াকে মনে হয় বান্দরবানের পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়ানো মেঘ। কিন্তু এসি গাড়িতে চলাফেরা করা মানুষের সংখ্যা খুব বেশী না। ৯০ ভাগ মানুষই ননএসি নানা গাড়িতে আসা-যাওয়া করেন। মেয়র সাহেবদের এক্ষেত্রে আমি দায়ী করছিনা। এই এলাকাতো ঢাকা নগরীর বাইরে। কিন্তু এভাবে কতদিন? কতদিন আমরা এভাবে ময়লা-প্রিয় থাকব?

প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস হয়, অফিস সাজানো হয় নতুন নতুন সাজে। মেয়র আসে মেয়র যায়, দামি দামি গাড়ি কেনা হয়। প্রমোশন হয়, সরকারি চাকরি পায় শত শত মানুষ। কিন্তু ময়লা আবর্জনার কোনো সুরাহা হয়না। মেয়র সাহেবরা মিডিয়াকে ডেকে এনে কোদাল বা ঝাড়ু দিয়ে সামান্য ময়লা আবর্জনা সাফ করে ছবি তুলে, ভিডিও দিয়ে গণমাধ্যমে জায়গা করে নেন বটে, কিন্তু ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় খোলা ডাস্টবিনে বিকট গন্ধের ময়লা কমেনা।

লেখকঃ সহকারি অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :