এক হাতেই জ্ঞানের পসরা সাজিয়ে পেটে ভাত

নজরুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০১৭, ১৯:২৬ | প্রকাশিত : ২৬ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:১৬

মঙ্গলবার বিকেল ৪টা। রাজধানীর বিজয় সরণিতে ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি থামাতেই এক ব্যক্তি বই হাতে এ-গাড়ি ও-গাড়ির জানালায় ছুটছেন। গলায় গামছা ঝোলানো। পেটের কাছে গামছার ওপর এক টুকরা কাঠ। তার ওপর অনেকগুলো ইংরেজি বই। গলায় গামছা ঝোলানো বইগুলো ডান হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন। এই একটিই মাত্র হাত তার। অন্যটি অর্থাৎ বাঁ হাতটি কাঁধ থেকে নেই।

মানুষটি ঘুরে ঘুরে বই বিক্রির চেষ্টা করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্রেতার কাছ থেকে বিফল হন। সিগন্যাল ছেড়ে দিলে উঠে আসেন ফুটপাতে।

রাজধানীবাসীর প্রাত্যহিক একটি যন্ত্রণার নাম যানজট। এই যানজটই আবার ওই বইওয়ালার মতো মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়। গাড়ি যত বেশি সময় আটকে থাকে তারা তত বেশি খুশি।

মানুষটির সঙ্গে কথা বলতে সামনে এগিয়ে যাই। ক্রেতা মনে করে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কী বই লাগবে?

নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাই তার কথা- তার বই বিক্রির কথা, জীবনের কথা।

আর বিশেষ প্রশ্ন না বাড়িয়ে যখন বলতে শুরু করেন তার জীবনের গল্প, পাশ থেকে একজন হকার তাকে পরামর্শ দেন, ‘হুদাই সময় নষ্ট না কইরা বই বিক্রি করো, চাচা।’এ কথা শোনার পরও জীবনের গল্প চালিয়ে গেলেন লোকটি। তার নাম গফুর সরদার।

রাজধানীর বিজয় সরণি হয়ে যাদের রোজ যাতায়াত, তাদের কাছে পরিচিত মুখ এটি। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর‌্যন্ত বই হাতে ছুটে বেড়ান সিগন্যালে থামা গাড়িতে গাড়িতে।

গফুর সরদার প্রায় ২৭ বছর বিজয় সরণির ট্রাফিক সিগন্যালে বই বিক্রি করছেন। তার বয়স এখন ৫০ বছর। ঝুঁকি নিয়ে এভাবে বই বিক্রি কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে গফুর বলেন, ‘আমার জীবনটা সিগন্যালে চলে গেল। বই বিক্রির আগে কলম, পেন্সিল, গলার হার, চাবির রিং বিক্রি করতাম। কিন্তু এগুলা বিক্রি করে যে টাকা পাইতাম পেট চালানো কষ্ট হয়ে যেত। তাই বই বিক্রি শুরু করি। আমার বইয়ের জন্য আলাদা একটা ভালো লাগাও আছে, আর আয়ও বেশি।’

তার বিক্রির তালিকার বইগুলো দেখে রীতিমতো চমকে উঠতে হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, শারমিন আহমেদের ‘নেতা ও পিতা (তাজউদ্দিন আহমদ ‘,পাওলো কোয়েলহোর ‘স্পাই’, স্টিভ জবসের ‘দ্য মেন হু থিংক ডিপরেন্ট’, মালালা ইউসুফজাইয়ের ‘আই এম মালালা’, আনা ফ্রাংকের ‘ডায়েরি’, হ্যারি পটার সিরিজের বই ছাড়াও রয়েছে সাড়া জাগানো সব ইংরেজি বই।

গফুর সরদারের বাড়ি যশোরের কেশবপুরে। ছোটবেলায় রেল দুর্ঘটনায় বাঁ হাতটি হারান। সাত ভাইবোন নিয়ে তার বাবা-মায়ের দরিদ্র সংসারে বড় হয়েছেন। তিনি পরিবারের শেষ সন্তান ছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মায়ের মৃত্যুর কারণে পড়াশোনার সুযোগ পাননি। তবে কিছুদিন এক নৈশকালীন স্কুলে পড়েছেন। এখন মহাখালীর সাততলা বস্তিতে থাকেন। মাসে ভাড়া গুনতে হয় এক হাজার টাকা। গফুর সরদারের চারজনের সংসার।দুই ছেলেকে নিয়ে তার স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকেন। গফুর সরদার বলেন, জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তার বড় ছেলে মারা যায় ১২ বছর আগে। মেজো ছেলেও একই রোগে আক্রান্ত। টাকার অভাবে বড় ছেলের চিকিৎসা করাতে পারেননি, এখন একই সমস্যার কারণে মেজো ছেলের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। আর ছোট ছেলে পড়ছে পঞ্চম শেণিতে। বই বিক্রি করেই সংসার চালাতে হয় গফুর সরদারকে। প্রতিদিন বই বিক্রি করে ৩০০-৪০০ টাকার মতো আয় করেন তিনি।

আয়ের কথা বলতে বলতে তার চোখ পানিতে টলমল করতে শুরু করে। কিছুটা সময় চুপ করে থাকেন তিনি। কয়েক মিনিট পর বলেন, ‘শূন্যপথে আছি, ভবিষ্যৎ নাই। যে কয়টা টাকা জমাইছি সব বড় ছেলের পেছনে চলে গেছে, মেঝো ছেলেটারও একই রোগ। বাড়া বাসায় থাকি। সংসার চালামু, না বাপের যে ভিটা পাইছি ওইঠাতে ঘর দিমু।’

গফুর সরদারের স্বপ্ন নিজ এলাকা যশোরে একটা লাইব্রেরি দেওয়ার। কিন্তু মূলধন পাবেন কোথায়? এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আবার নেমে পড়েন রাস্তায় বই বিক্রি করতে।

(ঢাকাটাইমস/২৬এপ্রিল/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :