গ্রামে-গঞ্জে নির্বাচনের আগাম উত্তাপ

রিমন রহমান, রাজশাহী
| আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০১৭, ১১:৪৭ | প্রকাশিত : ২৬ এপ্রিল ২০১৭, ১১:২২

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র দেড় বছর। তাই এখন নির্বাচনের মাঠ গোছাতে শুরু করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজশাহীর সংসদ সদস্যরা। থেমে নেই মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতারাও। দলীয় মনোনয়ন পেতে তারাও নির্বাচনী মাঠে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন। ফলে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে নির্বাচনের আগাম উত্তাপ।

রাজশাহীর মোট ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই চরম নির্বাচনী উত্তাপ বইছে। রাজশাহীর ৯ উপজেলা নিয়ে গঠিত এই পাঁচ আসনে বর্তমান এমপিদের পাশাপাশি মনোনয়ন পাওয়ার আশায় অন্য নেতারাও মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। নেতাকর্মীরা বলছেন, মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাদের কারণে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন বর্তমান এমপিরা।

জানা গেছে, দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে টানা এবং নিজ দলের নেতাদের সঙ্গেই বিরোধে জড়িয়ে পড়ার কারণে রাজশাহীর পাঁচ এমপিকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। তাছাড়া ঢাকায় পাঠানো গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনও কোনো কোনো এমপির পক্ষে নেই বলে নিশ্চিত করেছেন সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা।

দলীয় সূত্র মতে, জেলার ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-১ আসন। এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রণালয় পেয়েছেন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান, ব্যারিস্টার আমিনুল হক ও সর্বশেষ ওমর ফারুক চৌধুরী। বর্তমানে এই আসনের এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়েছেন তিনি। এর আগে নবম সংসদেও তিনি এই আসনের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

তবে গত সংসদ নির্বাচন থেকেই মনোনয়ন নিয়ে তার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজি মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান। ওই নির্বাচনেই তার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল ভালো। এবারও নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় তিনি নিজের পক্ষের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েছেন। সম্প্রতি তিনি তানোর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। গত ২৬ মার্চ গোদাগাড়ী উপজেলা সদরে বর্তমান এমপির সামনেই প্রায় আড়াই হাজার নেতাকর্মীকে নিয়ে শোডাউন দিয়েছেন মতিউর রহমান।

আওয়ামী লীগ প্রীতির কারণে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মতিউর রহমানকে চাকরিচ্যুত করে। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রাজশাহী জেলার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন মতিউর রহমান। এবার দল তাকে মনোনয়ন দেবে বলে আশা করছেন তিনি। এছাড়া ওই আসনটি থেকে এবার নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মকবুল খান। তানোর আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানীও এই আসনে মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। ফলে রাব্বানী-মকবুল-মতিউরের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী।

পবা-মোহনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৩ আসন থেকে এমপি হয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আয়েন উদ্দিন। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব প্রকট। আর এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত নির্বাচনে দলের মনোনয়নকে কেন্দ্র করেই।

জানা গেছে, এই আসন থেকে এবার মনোনয়ন চান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ। দুই উপজেলা আওয়ামী লীগের বড় একটা অংশ আসাদুজ্জামান আসাদের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। আসাদও বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন।

তবে অভিযোগ আছে, তাতে বিভিন্নভাবে বাধার চেষ্টা করেন এমপি আয়েন। সম্প্রতি পবা উপজেলার কাপাশিয়ায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার ও আসাদুজ্জামান আসাদকে সংবর্ধনা দেয়ার আয়োজন করা হয়। সেখানে হামলার ঘটনা ঘটে। পরে হামলাকারীরা ধাওয়া খেয়ে বিতাড়িত হন।

অভিযোগ ওঠে, এমপি আয়েনের ক্যাডার বাহিনী ওই অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়ে তা পণ্ড করার চেষ্টা করে।

রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের একটা অংশের বিরোধ আছে। এমপি এনামুল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও উপজেলা আওয়ামী লীগেরই সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টুর সঙ্গে তার বিরোধ তুঙ্গে। আসনটিতে সান্টু এবার মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশকে নিয়ে নিজের মতো করে মাঠ গুছিয়ে যাচ্ছেন সান্টু।

জেলার পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৫ আসনের বর্তমান এমপি কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা। এই আসনের সাবেক এমপি আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক। বেশকিছু দিন নিস্ক্রিয় থাকলেও এই আসনটিকে টার্গেট করে তিনি আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠছেন। বেশ কিছুদিন থেকে তিনি আবারও এসব এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে ধারবাহিকভাবে জনসংযোগ শুরু করেছেন।

সম্প্রতি উপজেলা সদরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকারকে দুর্গাপুর পৌরসভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ ও তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীরা বর্তমান এমপি আবদুল ওয়াদুদ দারার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে আগামী নির্বাচনে তারা তাকে মনোনয়ন না দেয়ার জন্য দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য দেন।

এর আগে প্রায় ৩শ মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউন করে এমপিবিরোধীরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

দলীয় সূত্র মতে, বিগত সংসদ নির্বাচনে প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুককে বাদ দিয়ে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয় ব্যবসায়ী কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারাকে। এরই মধ্যে তাজুল ইসলাম ফারুককে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে ছয় বছর পর নতুন কমিটির অনুমোদন দেয়া হয়। এসব প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক নানা উত্থান-পতনের ফলে বেশ কিছুদিন তিনি রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে থাকেন।

এতে তাকে ঘিরে শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। এসব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সম্প্রতি তিনি আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। তার টার্গেট হারানো আসন ফিরে পাওয়া। এ জন্য তিনি ওই এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগও করছেন।

দলীয় নেতারা বলছেন, এ আসনে তাজুল ফারুক ছাড়াও মনোনয়ন চান জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল মজিদ সরদার ও সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক মাসুদ। তাদের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন বর্তমান এমপি।

রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসন থেকে নির্বাচিত শাহরিয়ার আলম রাজশাহীর সবচেয়ে ক্লিন ইমেজের এমপি। তিনি সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীরও দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এ আসনের সাবেক এমপি চারঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রায়হানুল হক রায়হান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলু এবং বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাস আলী মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। এই তিন নেতা নিজেদের মতো করে মাঠ গোছাচ্ছেন বলেও জানা গেছে। তবে শাহরিয়ার আলমের ক্লিন ইমেজ থাকায় তিনিই মনোনয়ন পাবেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী জানান।

এসব বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী ও আয়েন উদ্দিনের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে কথা হয়, পুঠিয়া-দুর্গাপুরের এমপি কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারার সঙ্গে। তিনি বলছেন, ‘রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। যে কেউ মনোনয়ন চাইতেই পারেন। কিন্তু যারা মনোনয়নের জন্য দৌঁড়াচ্ছেন, তারা সফল হবেন না। আওয়ামী লীগের একটা অবস্থান আছে। ‘দুষ্টামি করলেই মনোনয়ন পাওয়া যায় না।’

রাজশাহীর পাঁচ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী আসাদুজ্জামান আসাদ, মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, রায়হানুল হক রায়হান, জাকিরুল ইসলাম সান্টু ও তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক বলছেন, বর্তমান এমপিদের এলাকায় শক্ত কোনো অবস্থান নেই। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কিংবা সম্পাদকরাই যদি এমপিদের বিরোধিতা করেন, তাহলে তৃণমূল তাদের মূল্যায়ন করবে না। পরিবর্তনের জন্যই তারা মাঠে কাজ করছেন। দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারেও তারা আশাবাদী।

রাজশাহীর ৯ উপজেলা নিয়ে গঠিত পাঁচটি সংসদীয় আসনে রীতিমতো মনোনয়ন যুদ্ধের পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও এর বিপরীত অবস্থা রাজশাহী সদর আসনটিতে। মহানগর নিয়ে গঠিত রাজশাহী-২ আসনের বর্তমান এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। জোটের কারণে এই আসনে তিনি আবারও মনোনয়ন পাবেন বলে ধারণা করা হয়। শুধু শহরের এই আসনটিতেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। বাকি গ্রামের আসনগুলোতে ছড়াচ্ছে নির্বাচনের আগাম উত্তাপ।

(ঢাকাটাইমস/২৬এপ্রিল/ব্যুরো প্রধান/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :