চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশিষ্টজনের ভাবনা

প্রকাশ | ২৭ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:২৪ | আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৭, ১১:২৫

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম

বর্ষাকাল আসতে এখনো ঢের বাকি। কিন্তু গত কয়েক দিন যেভাবে বৃষ্টি শুরু ঝরেছে, তাতে যেন আড়াল পড়ে গেছে গ্রীষ্মকাল। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ-দুর্ভোগ মোকাবিলায় আমরা কতটুক প্রস্তুত?

জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি দুর্যোগে-দুর্ভোগ বৃদ্ধির পেছনে আছে মনুষ্যসৃষ্ট নানা অপতৎপরতাও। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন উন্নয়ন, প্রকৃত সমস্যার দিকে নজর না দেওয়া এবং অপর্যাপ্ত উন্নয়ন বরাদ্দসহ নানা কারণে জনদুর্ভোগ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম মহানগরজুড়ে জলাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আসলে নগর উন্নয়নে সত্যিকারের জনহিতকর পদক্ষেপ নেই তেমন। পূর্বসূরিদের মতো বর্তমান নগরপিতাও তার নির্বাচনী ইশতেহারে নগরীর জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত উদ্যোগ খুবই দুর্বল এবং অবৈজ্ঞানিক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বলিষ্ঠ বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ থাকলে কর্ণফুলী নদীপারের নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। জলাবদ্ধতার কারণগুলো যে মানবসৃষ্ট এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপ থাকলে চট্টগ্রাম মহানগরকে জলাবদ্ধতার অভিশাপমুক্ত করা যায়, তা বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন।

এ নিয়ে চট্টগ্রামের নগর পরিকল্পনাবিদসহ বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলাপকালে তারা ঢাকাটাইমসকে জানান নানা সমস্যার কথা। তাদের মতে, নগরীর পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণে যথাক্রমে হালদা-কর্ণফুলী ও বঙ্গোপসাগর থাকায় যেমন পানি নিষ্কাশনের সুবিধা রয়েছে,  তেমনি বৃষ্টির সময় জোয়ারের পানি নগরীতে প্রবেশ করার পর তা নিষ্কাশনের পথে বড় সংকট।

নগর পরিকল্পনাবিদ দেলোয়ার হোসেনের মতে, চট্টগ্রাম এমন একটি নগর যেখানে পাহাড়, সাগর, নদী, সমতল সবই আছে। নিষ্কাশনের জন্য এর সুবিধা হলো পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণে- হালদা, কর্ণফুলী ও বঙ্গোপসাগর, যেখানে সরাসরি নিষ্কাশন সুবিধা রয়েছে। উত্তরের পাহাড় অতিক্রম করে তার উত্তরের পানি শহরে প্রবেশ করতে পারে না।

আবার অসুবিধা হলো জোয়ারের পানি শহরে প্রবেশ করে, বৃষ্টি ও জোয়ার একসঙ্গে হলে বৃষ্টির পানি নামতে পারে না, পাহাড় ক্ষয়ের বালি নালা-খাল ভরাট করে নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এই প্রাকৃতিক বিষয়গুলো ছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা হলো পাহাড় কেটে ক্ষয় বাড়ানো, খাল-নালা অপদখল করে নিষ্কাশন পথ সংকুচিত করা, পানি-গ্যাস-টেলিফোন লাইন টেনে নালা-খাল এ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা এবং পুকুর-দীঘি-জলাশয় ভরাট করা।

সমস্যার প্রকটতা

দেলোয়ার হোসেনের মতে, কয়েক বছর আগ পর্যন্ত শুধু বর্ষা মৌসুমে সমস্যা প্রকট হতো, এখন বিশেষ করে আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকা ও হালিশহরের মানুষ বছরের অধিকাংশ সময়ই দিনের নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে নিজ গৃহেও যাতায়াত করতে পারে না। গত বর্ষায় তিন দফা সর্বগ্রাসী জলাবদ্ধতায় মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এবং স¤পদহানি হয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকার।

নগর পরিকল্পনাবিদ দেলোয়ার হোসেনের মতে, এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন বিবেচনায় নিয়ে প্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারের কাছে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাতে হবে। প্রয়োজনে সরকার বন্দর কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগাতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের দায়িত্ব নিতে হবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা। এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন কেবল কার্যকর উদ্যোগ।

ড্রেনেজ বিশেষজ্ঞ মো. হুমায়ূন কবির বললেন, চট্টগ্রাম নগরে দুই কারণে জলাবদ্ধতা হয়। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি। বৃষ্টির পানি পরিবহনের মতো ক্যাপাসিটি নালা-নর্দমার না থাকা, কিছু খালের কালভার্ট প্রয়োজনের তুলনায় ছোট, অনেক নালা-নর্দমা ভরাট ও দখল থাকায় বৃষ্টির পানি জমে থাকে। অন্যদিকে ওয়াসা, বিদ্যুৎ, টিঅ্যান্ডটি, গ্যাসের পাইপলাইনগুলোর অপরিকল্পিত সঞ্চালন। এগুলোও বর্জ্য আটকে পানির গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে। আবার বৃষ্টির সময় জোয়ার থাকলে বৃষ্টির পানি উল্টো নগরে প্রবেশ করে। এ ক্ষেত্রে পা¤প স্টেশন প্রয়োজন।
জানা যায়, এ প্রকল্পের আওতায় কালুর ঘাট ব্রিজ থেকে শাহ আমানত ব্রিজ পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি, বাঁধের ওপর চার লেনের সড়ক। নদীর তীর রক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ ছোট খালগুলো সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নেভাল একাডেমি থেকে ১০ নম্বর খাল পর্যন্ত অংশে কংক্রিটের তৈরি ঢেউ প্রতিরোধক দেয়াল নির্মাণ হবে।

এর সঙ্গে আছে হালদা এবং কর্ণফুলী নদীর শাখা হিসেবে নগরে প্রবাহিত ২৭টি খালের মোহনায় স্লুইস গেট ও বাঁধের তলদেশে ১০টি কালভার্ট নির্মাণ। পলি দ্বারা ভরাট হয়ে যাওয়া শহরের ১৬টি খালসহ অন্য খালগুলোও সংরক্ষণ করা হবে। ১১ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ১১টি খালের ড্রেজিং হবে। মহেশ খালের ৯ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার অংশজুড়ে ড্রেজিং ও বাঁধ নির্মাণ হবে। একইভাবে রাজাখালী খালের ড্রেজিং ও বাঁধ নির্মাণ হবে।

এই দুই বিশেষজ্ঞের মতে জলাশয় ভরাট, পরিকল্পনাহীনভাবে ভবন-স্থাপনা নির্মাণ, খাল-নালাকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার প্রবণতা, অপরিকল্পিত পাহাড় কাটা, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করা, আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা এবং দখল জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৯৫ সালে যে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান করেছিল গত ২২ বছরেও তা বাস্তবায়নে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

ফলে জলাবদ্ধতা নিরসন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রধান ইস্যু হলেও নির্বাচনের পর কেউ এ নিয়ে বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি।

১৯৯৫ সালে তৈরি করে চট্টগ্রামের নগরীর ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান। ওই প্ল্যানে তিনটি নতুন খাল খনন, নদী ও সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত খালের মুখে স্লুইচগেট স্থাপন, বিলুপ্ত খাল পুনরুদ্ধার, বিদ্যমান খালগুলোকে গভীর ও প্রশস্থকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২২টি বছর পার হয়ে গেলেও তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি।

নগর পরিকল্পনাবিদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা যায়, মহানগরে জলাবদ্ধতার জন্য বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। নগরীর মধ্য দিয়ে যেসব খাল-নালা নর্দমা রয়েছে সেগুলো বেদখল হয়ে গেছে। অতিবৃষ্টিতে কর্ণফুলী নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানি চাক্তাই খাল, ডোম খাল, হিজড়া খাল, নয়া মির্জা খাল, শীতল ঝর্ণা খাল, বামুননয়া হাট খাল, গুলজার খাল, বীর্জা খাল, ইছান্যা খাল, মাইট্টা খাল, লালদিয়ার চর খাল, ত্রিপুরা খাল, নাছির খাল, গয়না ছড়া খাল, কাট্টলী খাল, চশমা খাল দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করে থাকে। নগরীর মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৭টি খাল একশ্রেণির খালখেকোর কবলে পড়ে এখন নালায় পরিণত হয়েছে। এসব খালের আশপাশে বসবাসকারী লোকজন শুধু খাল ভরাট করে ভবন, দোকান তৈরি করে ক্ষান্ত হয়নি, খালগুলোকে আর্বজনা ফেলার স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে।

তাছাড়া চাক্তাই খাল, রাজাখালী খালের মুখে কর্ণফুলী নদীতে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়াতে অনেক সময় পানি কর্ণফুলী নদীতে নামতে পারে না। আবার কর্ণফুলী নদীতে জোয়ার থাকলে সে সময় যদি বৃষ্টি হয় তাহলে নগরীর

খাল-নালানর্দমা দিয়ে প্রবাহিত পানি আর সে সময়ে কর্ণফুলীতে নামতে পারে না। ফলে খুব তাড়াতাড়ি এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ভারি বৃষ্টিপাত হলে পরিস্থিতি হয় আরো ভয়াবহ।

নানা সময়ে মেয়ররা ঢাকডোল পিটিয়ে খাল ও নালা খননের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন জলাবদ্ধতা থাকবে না। কিন্তুগত ৩০ বছরেও পরিবর্তন নেই জলাবদ্ধতা দুর্ভোগের।

সাধারণত জুন-জুলাই কিংবা আগস্টের বৃষ্টিতে নগরীতে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে থাকে। এবার বর্ষার আগেই জলাবদ্ধতা। অন্যান্য বছর নগরীর বিভিন্ন এলাকার নালা ও খালগুলো অক্টোবর-নভেম্বর মাসে শীত মৌসুমে মাটি উত্তোলন করা হলেও এবার তা হয়নি।

এই অভিযোগ স্বীকার করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একজন দায়িত্বশীল প্রকৌশলী জানান, প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বরে নগরীর নালা ও খালগুলো থেকে মাটি উত্তোলন করা হলেও এবার তা হয়নি। আর এর পেছনে রয়েছে প্রকৌশলীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। টেন্ডার আহ্বানের জন্য ফাইল তৈরির কথা থাকলেও প্রকৌশলীরা তা যথাসময়ে করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

চসিক মেয়রের বক্তব্য

তবে চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির বিশেষ করে বহদ্দারহাট এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ওভারব্রিজকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, ইতোমধ্যে ৫৭টি দরপত্রের মাধ্যমে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকার দরপত্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আগামী ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এসব কাজ হয়ে গেলে বর্ষা মৌসুমে আর নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় ভুগতে হবে না।

মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চীনা অর্থায়নে জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পদ্ধতিতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ফ্ল্যাড কন্ট্রোল অ্যান্ড ওয়াটার লগিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম শীর্ষক প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। প্রকল্প শেষ হলে জলবদ্ধতা নির্বাসনে যাবে।

চউক চেয়ারম্যান যা বলেন

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এ প্রসঙ্গে বলেন,  জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের অভিশাপ। চট্টগ্রামবাসী আর কথা শুনতে চান না। এ অভিশাপ থেকে মুক্তি চায়। মেয়র মহোদয় করবেন, নাকি পানি উন্নয়ন বোর্ড করবে, ওয়াসা না চউক করবে তা বড় বিষয় নয়। নগরবাসী পরিত্রাণ চায়।

চউক চেয়ারম্যঅন বলেন, জলাবদ্ধতা এক দিনের সমস্যা নয়। এটি বহু দিনের সমস্যা। কে কী রকম দায়ী তা বলব না। আমরা সবাই দায়ী। যখন চোখের সামনে নালা-খাল দখল ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে, তখন চুপ করেছিলাম। দোকানের ময়লা নালা-খালে নিক্ষেপ করা হয়েছে, খাল দখল করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা সবাই যদি আন্তরিক না হই এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা না চালাই তাহলে ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাই হতে পারে এই ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে উত্তরণের উপায়।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের ২২ বছর পর এসে বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়, তাহলে বিষয়টি কতটুকু শোভনীয় শোনায়? মহাপরিকল্পনা বাস্তবতার নিরিখে এখন বিশাল তারতম্য সৃষ্টি হয়েছে। তাই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে চউক মহাপরিকল্পনা রিভিউ করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে বলে জানান চেয়ারম্যান।

(ঢাকাটাইমস/২৭এপ্রিল/মোআ)