বিপর্যস্ত হাওর এবং কিছু প্রস্তাব

অনুপম মাহমুদ
 | প্রকাশিত : ৩০ এপ্রিল ২০১৭, ২০:১৬

দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি জেলার প্রায় ৩৪টি উপজেলায় বিস্তৃত ৪১১টি ছোট-বড় হাওর নিয়ে আমাদের ভাটি এলাকা। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের প্রায় আট হাজার বর্গমাইল, অর্থাৎ প্রায় সাত ভাগের এক ভাগ। ষোল কোটির এক অষ্টমাংশ অর্থাৎ দুই কোটি মানুষের আবাস এই হাওর এলাকায়।

হাওর একটি বিচিত্র এলাকা। দেশের অন্য যেকোনো এলাকা থেকে এটা সম্পূর্ণরূপে ব্যতিক্রম। এখানকার ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, যানবাহন সবকিছুই ব্যতিক্রম। বছরের প্রায় চার মাস গোটা হাওর এলাকা থাকে পানিতে নিমগ্ন।

হাওর এলাকা জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে বেশ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী উদ্ভিদ দেখা যায়, যেমন: হিজল, তমাল, করচ, ভুই ডূমুর, জল ডুমুর, বরুণ, হোগলা, নল খাগড়া, বনতুলসী, বলুয়া ইত্যাদি। এছাড়া হাওরে শাপলা, শালুক, ঢ্যাপ ইত্যাদি জলজ গুল্ম আছে প্রচুর পরিমাণে।

কিন্তু প্রকৃতির রুদ্ররোষ, হাওর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক উদাসীনতা, ঠিকাদারদের সীমাহীন দুর্নীতি এবং ক্ষমতাহীন স্থানীয় সরকার প্রশাসনের অদক্ষতায় হাওর আজ বিপর্যস্ত। বছরের পর বছর আগাম বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে হাওরের ফসল। এই বছর যুক্ত হয়েছে পানিতে দূষণজনিত মৎস্যসম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। মাছের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি হারিয়ে পথে বসেছেন হাওরের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।

আমরা সবাই জানি ভাটি এলাকার পেশা মূলত দুটি। (১) কৃষি এবং (২) মৎস্য আহরণ। কৃষিপণ্যের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ধান। এছাড়া গম, পাট, ভুট্টা, সরিষা, ধঞ্চে, মরিচ, বাদাম অন্যতম। এই এলাকার ৯০ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল যদিও তাদের অধিকাংশই জমির মালিক নন। বর্গা চাষ করে টিকে আছেন নানা প্রতিকূলতার মধ্যে। কৃষি উৎপাদন ব্যয় যে হারে বাড়ছে সেই হারে কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। মহাজনের দাদন, এনজিওর ক্ষুদ্রঋণের মায়াজালে বন্দী কৃষক ৩/৪ মাসের জন্য ৫০% হারে পর্যন্ত ঋণ নিয়ে থাকেন। সরকারি ও বেসরকারি তফসিলি ব্যাংকগুলো এখানে অপ্রতুল। স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বর্গ এই ঋণের প্রাপ্তিতে ভাগ বসায় বলে জনশ্রুতি আছে। আর এই অসাধু কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন ব্যাংকের অতিপয় বিপথগামী কর্মকর্তা। সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এবারের বন্যায় তফসিলি ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় স্থগিত করলেও এনজিওগুলো তা মানবে কি না তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ ব্যাপক আছে। ব্যাংকের তুলনায় অনেক গুণ বেশি ঋণ নেয় হাওরবাসী এনজিও থেকেই। তার চেয়েও আতঙ্কের কথা হচ্ছে মহাজনের কাছ থেকে নেয়া উচ্চহারের দাদন। এই মহাজনের দাদনের ফাঁদে পা দিয়ে ভিটে মাটি ছাড়া হবে এবার অগণিত কৃষক, এর তালিকা ইতিহাসে কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

দেশীয় প্রজাতির মৎস্য প্রজননের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে হাওর। এখানে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়। এছাড়া জেওয়াল মাছ, বিশেষ করে শিং, মাগুর, পুঁটি, বোয়াল, বাইম, টাকি, প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। দেশের মোট মৎস্যসম্পদের প্রায় ২৫ ভাগ মৎস্যের যোগান দেয় হাওর। এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের প্রাণিজ চাহিদার ৬০ শতাংশ আসে এই মৎস্য থেকে। এবার যে বিপর্যয় হয়েছে তা দেখা যায়নি নিকট অতীতে, কেউ ভাবেননি এইভাবেও হাওরের মাছে মড়ক লাগতে পারে।

এছাড়া উন্মুক্ত জলরাশি হাঁস-মুরগি পালনের জন্য ভীষণ উপযুক্ত। এই সুযোগে হাওরের যুবক ও নারী সমাজ সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে প্রশিক্ষণ ও ঋন নিয়ে গড়ে তুলেছেন প্রচুর হাঁস মুরুগির খামার। এবারের বন্যায় তাদের ক্ষতি হয়েছে সীমাহীন। তাদের পাশে যদি সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো না দাঁড়ায় তবে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আর কখনোই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না যার নেতিবাচক প্রভাব প্রভাব পরবে গোটা সমাজের ওপর। বেকারত্ব ও ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে তারা যদি ভুল করে নিজের ও সমাজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে তার প্রতিক্রিয়া হবে ভয়ঙ্কর।

হাওরের পলি মাটির নরম মানুষেরা আজ নগরের তপ্ত রাজপথে বেঁচে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ। গাঁয়ের কুলবধূর নরম হাত আজ তৈরি পোশাক শিল্পের সূচের ঘাইয়ে ক্ষত বিক্ষত। একসময় ধান কাটার মৌসুমে ভাটিতে উজানের মৌসুমী শ্রমিকের ঢল নামতো। এলাকার স্কুল, বাজার, সম্ভ্রান্ত কৃষকের বাড়ির দাওয়ায় তাদের স্থান সংকুলান হতো না। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে চাঙা হয়ে উঠতো হাওরের অর্থনীতি। হাঁটে মাঠে ঘাটে নানা পণ্যের পসরা নিয়ে মেলা বসাতো ভাসমান ব্যবসায়ীরা। পণ্য কেনাবেচা হতো তখন কাঁচা ধানের বিনিময়ে। এই দৃশ্য এবার আর দেখা যাবে না।

কৃষিতে ভর্তুকি নিয়ে এখনই চিন্তার কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাথে উন্নত দেশগুলো একটি চুক্তি করেছে, সেটা হলো ২০৩০ সালের পর থেকে কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ সেই প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে। কী হবে আজ থেকে ১৩ বছর পর? আমরা কি প্রস্তুত?

আমাদের বাংলা সাহিত্যে ময়মনসিংহ গীতিকা একটা বিশাল অংশজুড়ে বিদ্যমান, যার মূল ভিত্তি হলো ভাটি এলাকা। উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী, মনষা মঙ্গল, মহুয়া মলুয়া, হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, উকিল মুন্সি, হুমায়ুন আহমেদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ আমাদের হাওরের সৃষ্টি। তাদের সাহিত্যেও ফুটে উঠেছে হাওরের চালচিত্র।

হাওরের কৃষক সন্তান আমি, জীবন আর জীবিকার তাগিদে কৃষি থেকে বিচ্যুত হলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করি হাওরের জন্য। হাওরে জন্ম আমার, তাই হাওরের আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্না বা বিষাদ আমাকে স্পর্শ করে। হাওর নিয়ে কিছু প্রস্তাব তাই তুলে ধরছি বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে:

জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুকে সামনে রেখে হাওরের জন্য করণীয় নির্ধারণে অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে।

হাওরের বাঁধ ভাঙার কারণ অনুসন্ধানে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হাবে।

এবারের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।

ত্রাণ বিতরণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সেইসাথে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

হাওরে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্ব্যহীনতা দীর্ঘদিনের, তাই হাওরের জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষ এর মতো একটি স্বাধীন ও প্রয়োজনে স্বায়ত্বশাসিত একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করে হাওরের উন্নয়নে যাবতীয় কাজের তদারকি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

কৃষি ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত নয়, মওকুফ করতে হবে।

এনজিও ঋণের দায় থেকে হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও উদ্যোক্তাদের রক্ষা করতে সরকারের হস্থক্ষেপ জরুরি।

মহাজনের দাদনের হাত থেকে বিপর্যস্ত কৃষকদের রক্ষার উপায় খুঁজে বের করতে হবে, প্রয়োজনে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

হাওর এলাকায় সরকারি খাস জমি ও জলাভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হাবে। প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বণ্টন ও সত্যিকারের জেলেদের মধ্যে জলাভূমি বন্দোবস্ত দিতে হবে।

প্রাণীজ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে সুপারিশ জনসমক্ষে প্রকাশ করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

অবৈধ, অনৈতিক ও দুর্বৃত্তদের জলমহাল ইজারা প্রদান বন্ধ করে জাল যার জলা তার নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

হাওর এলাকার অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করে স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

হাওর এলাকার জনসাধারণের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাই। বছরের পর বছর হাওর এলাকায় হাসপাতালগুলো ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত প্রায় দুই কোটি মানুষ।

হাওর এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রাথমিক স্তরে বদলি শিক্ষক প্রথার বিলোপ ও এই ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যারাই যুক্ত তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।

হাওর এলাকার বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে হাওর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

হাওরকে দয়া করে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যেন ফায়দা না লুটে, এটা আপনাদের প্রতি হাওরবাসীর পক্ষে বিনীত অনুরোধ।

হাওরের বিপুল জলমগ্ন অঞ্চলকে পুঁজি করে পরিবেশবান্ধন পর্যটন কেন্দ্র সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে, বেকারত্ব কমবে আর শহরমুখী জনস্রোত কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে।

সরকারের একার পক্ষে এই কর্মযজ্ঞ সম্পাদনা কঠিন হবে। তাই প্রয়োজনে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলোকে আরও উৎসাহিত করতে হবে। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী ও এক সপ্তাংশ ভূখণ্ডকে রাষ্ট্রের মূল স্রোতধারায় ধরে রাখতে হবে, তা না হলে উন্নয়ন হবে বাধাগ্রস্ত আর ঘটবে ব্যাপক সামাজিক বিপর্যয়। হাওর নিয়ে ভাবার ও কাজ করার এখনই সময়...

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :