ভাগ্য যাদের আটকে আছে কষ্টের সীমারেখায়

ইমতিয়াজ উল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০১ মে ২০১৭, ১০:৩৪ | প্রকাশিত : ০১ মে ২০১৭, ০৯:২৩

বহমান নদীর স্রোতধারার মতো কেটে যাচ্ছে সময়। পরিবর্তন হচ্ছে সমাজব্যবস্থা। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি সবকিছুতেই এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শিল্পায়নের ফলে তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের। দক্ষতা বেড়েছে বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবী মানুষের। সেই সাথে বেতন বেড়েছে সরকারি চাকরিজীবীদের। কিন্তু এখনো খুব একটা ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি প্রান্তিক পর্যায়ের নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দিনভর খাটুনির পরেও তাদের ভাগ্য যেন আটকে আছে কষ্টের সীমারেখায়।

প্রখর রোদে কারো মালবোঝাই ভ্যান টেনে নিয়ে যাওয়া, শূন্যের ওপর ঝুঁকি নিয়ে বিয়ের গেইট সাজানো, নিত্য দিনের ব্যবহার্য দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পরিষ্কার করা, পেটের তাগিদে কোনো ওয়ার্কসপে কর্মব্যস্ত ছোট্ট শিশুটির কালিমাখা মুখ, দিনভর গালি আবার কখনো মার খেয়ে বাসের দরজায় ঝুলতে থাকা হেলপার পেশার নিম্ন আয়ের মানুষ...এমন অনেক দৃশ্য চোখে পড়বে আমাদের নিত্য।

ছবির এসব দৃশ্যপট কেবল রাজধানীর অদূরে ব্যস্ততম শিল্পাঞ্চল সাভার এলাকার। এভাবেই দিন ফুরিয়ে মাস পেরিয়ে বছর শেষ হয় ওদের। এক সময় দরিদ্রতার কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে কখনো স্বাভাবিক আবার কখনো দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু কাছে টেনে নেয় ভাগ্য বিড়ম্বিত এই মানুষগুলোকে। এমন দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যা সারাদেশে অগণিত।

দৃশ্য-১: প্রচণ্ড তাপদাহে যখন আমরা অনেকেই একটু আরাম পেতে এসির শীতল বাতাসে শরীর জুরাই। ঠান্ডা বরফে মেশানো এক গ্লাস শরবতে আয়েশ করে তৃষ্ণা মেটাই। ঠিক ওই মুহূর্তে হয়ত প্রথম আলোকচিত্রটির মতো মধ্যবয়সী এধরনের অসংখ্য নিম্ন আয়ের মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুই বেলার খাবার জোটাতে প্রখর রোদে মালবোঝাই বাহন টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বহুদূর। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় প্রচণ্ড গরমে এভাবেই মালবোঝাই ভ্যান টানতে দেখা যায় রুহুল আমিন নামে এই ব্যক্তিকে।

রুহুল আমিন আক্ষেপ করে বলেন, পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার পর থেকে দিনমজুরের কাজ শুরু করেছেন। এখন ভ্যান চালাতে হয়। দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা করতে না পারায় সমাজের আট-দশটা মানুষের মতো ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি তার। আগে জিনিসপত্রের দাম কম ছিল তাই দিন একশ থেকে দেড়শ টাকা মজুরির কাজ করেও যেভাবে চলেছে। এখন জিনিসের দাম বেশি হওয়ায় দিন পাঁচশ টাকা আয় হলেও একভাবেই পরিবার নিয়ে চলতে হচ্ছে। পরিবর্তনের মধ্যে এখন শুধু মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। তাদের মতো অসহায় লোকদের নিয়ে ভাবার কেউ নেই। হয়ত এভাবেই ভ্যান টানতে টানতেই এক সময় তাকে পৃথিবী ছাড়তে হবে!

দৃশ্য-২: দ্বিতীয় আলোকচিত্রটিতে মাটি থেকে প্রায় এক-দেড়শ ফুট উঁচুতে আশুলিয়ার পলাশাবাড়ী এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই দড়ি দিয়ে বাঁশ বেঁধে বেঁধে বিয়ের গেইট তৈরি করছেন জামাল, সোহেল, আমিনুল ও ফারুকসহ বেশ কয়েক জন। আশুলিয়ার নয়ারহাট এলাকার হৃদয় ডেকোরেটরের হয়ে কন্ট্রাক্টে কাজ করছেন তারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করবেন তারা। মাঝে শুধু দুপুরে খাবার বিরতি। তারপরও কোনোভাবে তাড়াহুড়ো করে খেয়ে কাজে নামতে হবে তাদের। কেননা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গেইট তৈরির কাজ সম্পন্ন করার চুক্তি নিয়েছেন তাদের মালিক।

এদের মধ্যে ফারুক ঢাকাটাইমসকে বলেন, বিয়ের গেইট, রাজনৈতিক তোরণ ও প্যান্ডেল তৈরির কাজ করে থাকেন তারা। বিশেষ করে বিয়ের গেইট ও তোরণ তৈরিতে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে। পড়ে গিয়ে কখনো হাত-পা ভাঙ্গে আবার মারাও যায় অনেকে। গত বছর তাদের সাথেই কাজ করত খুলনার ছেলে শরীফ। হেমায়েতপুরে বিয়ের গেইট তৈরি করতে গিয়ে অনেক উপর থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায় সে। ওই সময় তারা এক লাখ টাকা চাঁদা তুলে শরীফের পরিবারকে দিয়েছিল। আর মালিকের কাছে জোর করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে নেয়া হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা।

তিনি আরও বলেন, বছরের সব সময় এই কাজ হয় না। মাসে খুব বেশি হলে ১৫-২০ দিন কাজ হয়। এ কাজের এজন্য সর্বোচ্চ দিন হিসেবে মজুরি সাড়ে ৮০০ টাকা পান তারা। তবে জিনিসপত্রের দামের তুলনায় তাদের এই আয় নিতান্তই কম বলে জানান তিনি।

দৃশ্য-৩: তৃতীয় আলোকচিত্রটিতে দশ বছরের শিশু আল-আমিন নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক সংলগ্ন একটি গাড়ির ওয়ার্কসপে কাজ করছে। বাবা-মা সংসারের অভাব অনটনের কারণে তাকে কাজে দিয়েছে বলে জানায় আমিনুল।

দৃশ্য-৪: চতুর্থ আলোকচিত্রের আনিছ নামের এই ছেলেটি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের একটি স্থানীয় পরিবহনের ভাড়া উঠানোর কাজ করে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে লেখাপড়া করা হয়নি তার। এই বয়সেই তাকে লোকজনের গালিগালাজ শুনে পরিবারের জন্য নিরন্তর কাজ করে যেতে হচ্ছে বলেও জানায় সে।

দৃশ্য-৫: পঞ্চম আলোকচিত্রের নারী শ্রমিক সুফিয়া বেগম পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে অনেক দিন ধরেই কাজ করেন। তবে দিন রাত পরিশ্রম করেও নিজের ভাগ্যর চাকা ঘুরাতে পারেননি তিনি। সংসারে কোনো আপদ এলে মনে হয় যেখান থেকে শুরু করেছি ঠিক যেন সেখানেই পড়ে আছি। সমাজে আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের ভাগ্য কোনোদিনও পরিবর্তন হয় না। এই সমাজে কেবল ধনীরাই আরো বেশি ধনী হচ্ছে বলেও জানান সুফিয়া।

দৃশ্য-৬: ষষ্ঠ আলোকচিত্রটিতে আশুলিয়ার পলাশবাড়ী এলাকায় নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশেই মো. বাচ্চুর রিকশা, ভ্যান ও সাইকেল সারানোর ছোট্ট দোকান। ১০-১৫ বছর যাবৎ এই কাজ করেন তিনি। আগে রিকশা ও ভ্যানের সংখ্যা বেশি ছিল তাই দিন এক হাজার থেকে বারশ টাকা পর্যন্ত আয় হতো বাচ্চুর। এখন এসব যান কমে যাওয়ায় তার আয়ও কমে চারশ থেকে পাঁচশ টাকায় নেমে এসেছে। তাই একটু বাড়তি আয়ের আশায় ঋণ করে একটি গ্যাস ঝালাইয়ের যন্ত্র কিনেছেন। যা দিয়ে এখন পরিবহনের ভাঙা যন্ত্রাংশ জোড়া লাগানোর কাজ করছেন বলেও জানায় বাচ্চু।

দৃশ্য-৭: জিয়াউর ও রইচ উদ্দিন নামে দুই ব্যক্তিকে সপ্তম আলোকচিত্রে বাসা বাড়ির ব্যবহৃত দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে দেখা যাচ্ছে। আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ, ডেন্ডাবর, কবরস্থানরোডসহ বিভিন্ন এলাকার বাসা বাড়ির ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ করেন তারা। এজন্য মাসিক বেতনও আছে তাদের। তবে যার অঙ্ক এই পরিশ্রমের চেয়ে অনেক কম বলে জানান জিয়াউর ও রইচ। কারণ, আবর্জনার গন্ধ সহ্য শুকতে শুকতে মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তাদের মধ্যেই অনেকে। কিন্তু পেটের তাগিদে তারপরও এই কাজ করতে হচ্ছে তাদের।

দৃশ্য-৮: অষ্টম আলোকচিত্রটিতে এক যুবককে বৈদ্যুতিক কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। এলাকায় ইলেকট্রিশিয়ান নামে পরিচিত মকবুল ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অনেক দিন আগেই গ্রাম থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাভারে। কাজ করেন বাসা বাড়িসহ বিভিন্ন গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানে। এজন্য দিন শেষে টাকা পান মকবুল। তবে মাঝে মধ্যেই কাজ করার পরও তার পাওনা টাকা নিয়ে তালবাহানা করে অনেকেই।

দৃশ্য-৯: সবশেষের ছবিটি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ধামরাইয়ের জয়পুরা এলাকার ক্ষুধার্ত রুক্ষè চেহারা বৃদ্ধ এক ব্যক্তির। খাবারের জন্য অনেকের কাছে সাহায্য চাইতে দেখা গেল লোকটিকে। সাহায্য পেতেই নিজের নামটা না বলেই ভোঁ দৌড় দেয় লোকটি। দিশেহারা হয়ে দ্রুতগতির চলাচলের মহাসড়কটি পাড় হয়ে চলে যায় সে। ভাবতে থাকি- কি পরিণতি এসব মানুষের? কত না কষ্টে আঁকা জীবন এই মানুষগুলোর!

(ঢাকাটাইমস/০১মে/আইআই/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :