বিচারহীনতায় উত্তরের ১৬ জেলার শ্রমিক

রিমন রহমান, রাজশাহী থেকে
 | প্রকাশিত : ০১ মে ২০১৭, ১০:০০

নাটোরের লালপুর উপজেলার বালিপিতা গ্রামের আবু জোবায়ের হোসেন (৩৫) দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করতেন নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তার বেতন পরিশোধ করা হয়নি। আবার দীর্ঘদিনেও তার চাকরি স্থায়ী করা হয়নি। উল্টো গত বছরের জুলাইয়ে তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়।

চাকরি ও বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে গত বছরের ২৭ জুলাই আবু জোবায়ের হোসেন রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম আদালতে একটি মামলা করেন। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ মাস ধরে আদালতে কোনো বিচারকই নেই। ফলে একটুও এগোচ্ছে না এই শ্রমিকের মামলা। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে গতকাল রবিবার আবু জোবায়ের বলেন, চাকরি না থাকায় পরিবার নিয়ে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে কাটছে তার দিন।

বিচারকের অভাবে শুধু আবু জোবায়ের হোসেনের মামলাই ঝুলে আছে তা নয়, গতকাল রবিবার পর্যন্ত আদালতটিতে শ্রমিকদের ২৭৮টি মামলা ঝুলে ছিল। গত সাড়ে পাঁচ মাস ধরে এসব মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। শুধু একটার পর একটা তারিখ পড়ছে। মামলার প্রতি তারিখেই শ্রমিকরা দূর-দূরান্ত থেকে আদালতে গিয়ে জানতে চাইছেন, কোনো বিচারক যোগ দিয়েছেন কী না। কিন্তু পাঁচ মাস ধরে হতাশ হয়ে ফিরছেন তারা।

এদিকে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ে আদালত থেকে কোনো সুসংবাদও পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় আজ সোমবার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন মহান মে দিবস। অথচ শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার এমন দিনেও রাজশাহীর শ্রম আদালতের এজলাসে কোনো বিচারক নেই। ফলে গোটা উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ে যেসব মামলা করেছিলেন, তার একটিরও নিষ্পত্তি হচ্ছে না।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বিভাগীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান ও জেলা জজ মাহফুজার রহমান বদলি হয়ে চলে যান। এরপর থেকে এখানে কোনো চেয়ারম্যানকে পদায়ন করা হয়নি। বর্তমানে আদালতের রেজিস্ট্রার তুষার কান্তি রায় চেয়ারম্যান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু কোনো মামলার বিচার করার ক্ষমতা তার নেই। ফলে থমকে আছে মামলার বিচারিক কার্যক্রম।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট সাতটি শ্রম আদালত রয়েছে। এরমধ্যে উত্তরাঞ্চলে আদালত রয়েছে শুধু রাজশাহী বিভাগেই। রংপুর বিভাগে কোনো শ্রম আদালত নেই। তবে রংপুর বিভাগের শ্রমিকদের জন্য রাজশাহী শ্রম আদালতের একটি সার্কিট বেঞ্চ বসানো হয়েছে বগুড়ায়। রাজশাহী বিভাগের আট জেলার শ্রমিকরা মামলা করেন রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম আদালতে। আর রংপুর বিভাগের আট জেলার শ্রমিকরা মামলা করেন রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম আদালতের বগুড়া সার্কিট বেঞ্চে।

আদালত সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগের জন্য আলাদা সার্কিট বেঞ্চ করা হলেও সেখানে আলাদা কোনো বিচারক নেই। প্রতি মাসে এক সপ্তাহ রাজশাহী থেকেই বিচারক, পেসকার ও পিয়নরা গিয়ে ওই বেঞ্চে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ মাস ধরে রাজশাহীতেই বিচারক নেই। ফলে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার শ্রমিকদের দায়ের করা মামলার একটিরও বিচারিক কার্যক্রম চলছে না।

সিরাজগঞ্জ স্পিনিং অ্যান্ড কটন মিলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে অধিকার খর্বের অভিযোগে ২০০৫ সালে রাজশাহী শ্রম আদালতে মামলা করেন কারখানাটির ১০ জন শ্রমিক। ২০০৮ সালে আদালত শ্রমিকদের পক্ষে রায় দেন। এই ১০ শ্রমিককে পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার ৯৬৬ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য আদালত কারখানা মালিক মেহেদি হাসান পারভেজকে নির্দেশ দেন। এ ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য রাজশাহীর আদালত সিরাজগঞ্জের জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসারকে নির্দেশনা দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত শ্রমিকরা তাদের ক্ষতিপূরণ পাননি।

ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের একজন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শহিদগঞ্জ গ্রামের ইউসুফ আলী (৫০)। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রায় বাস্তবায়নে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। সিরাজগঞ্জের জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসে বার বার গিয়েও কোনো ফল পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় আদালতের বিচারক সার্টিফিকেট অফিসারকে তাগাদা দেবেন। কিন্তু শুনছেন আদালতে কোনো বিচারকই নেই।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, এভাবেই উত্তরাঞ্চলে প্রতিনিয়ত শ্রমিকদের অধিকার খর্ব হচ্ছে। কিন্তু তারা যে আদালতের আশ্রয় নেবেন, সে সুযোগও কম। সব জেলায় নেই শ্রম আদালত, নেই এজলাস। রাজশাহী বিভাগের আট জেলার জন্য এজলাস মাত্র একটি। রংপুর বিভাগের জন্যও তাই। কিন্তু দুই বিভাগের বিচারক মাত্র একজন। গত সাড়ে পাঁচ মাস ধরে সে বিচারকও নেই। এতে বিচারহীনতায় পড়েছেন শ্রমিকরা।

শ্রমিকরা বলছেন, বিচারক আর এজলাস সংকটে দীর্ঘ দিনেও নিষ্পত্তি হয় না মামলা। তাই শ্রমিকদের নায্য অধিকার খর্ব হলেও কেউ সহজে আদালতের শরণাপন্ন হতে চান না। আবার যারা মামলা করেন, দূর-দূরান্ত থেকে আদালতে বিচার চাইতে যেতেই তাদের অনেক টাকা খরচ হয়। এখন বিচারকের অভাবে মামলার কার্যক্রম না চললেও প্রতি তারিখে হাজির হতে তাদের ভোগান্তি ঠিকই হচ্ছে। বাদীপক্ষের পাশাপাশি একই ভোগান্তি হচ্ছে বিবাদীপক্ষেরও।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম আদালতের রেজিস্ট্রার ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তুষার কান্তি রায় ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিচারক না থাকায় আমি শুধু তারিখের পর তারিখ দিয়ে যাচ্ছি। আমি তো জজ নই। তাই বিচার করতে পারি না। সমস্যার কথা শ্রম মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, দেশে শ্রম আদালতের বিচারক সংকট। রাজশাহীতে কবে বিচারক আসবেন তা বলা যাচ্ছে না।’

(ঢাকাটাইমস/০১মে/আরআর/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :