রিজভীর কথামালা কবে শেষ হবে!

মাহবুব রেজা
 | প্রকাশিত : ০২ মে ২০১৭, ১১:৪৮

বিএনপির রাজনীতিতে অনেকদিন ধরে একটা বিপর্যস্ত অবস্থা বিরাজ করছে এ কথা আর নতুন করে বলে দেওয়ার দরকার নেই। ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে দলের ভেতর এই অরাজকতা, চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়া সর্বোপরি শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ সমন্বয়হীনতা, কেউ কাউকে মানছেন না- সব মিলিয়ে দলটির ভেতর চলছে চরম বিশৃঙ্খলতা। নেতাদের ভেতর চলতে থাকা মতবিরোধ ও কোন্দলের কারণে দলটি সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে যেতে পারছে না। সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ মেইনটেইন করে বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা নিজেদের এসব ‘ঝুটঝামেলা’ থেকে সরিয়ে রাখছেন বলেও রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের অভিমতে জানা যায়।

বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্টরা এ সবকে আমলে নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, দলের ভেতর যদি এ ধরনের প্রবণতা চলতেই থাকে তাহলে সামনের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে খুঁজতে হলে গবেষণাগারে যেতে হতে পারে। তারা বলছেন, দলটির ভেতর ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মাঝারি সারির নেতৃত্ব, যাদের ওপর সাধারণ নেতা-কর্মীদের আস্থা কিংবা ভরসা কোনোটাই নেই। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর ভূমিকা ও তার বিভিন্ন ইস্যুতে আগ বাড়িয়ে লাগামহীন বেফাঁস কথাবার্তার বিষয়টি মোটা দাগে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলে হয়ত তার অবদান অনেকের চেয়ে বেশি। তাই বলে রুহুল কবির রিজভী নিজের প্রয়োজনে দলকে ব্যবহার করে প্রতিদিনই বিভিন্ন ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন করে কিংবা ব্যানার সর্বস্ব অঙ্গসংগঠনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলে দলের ভেতর ও বাইরে বিএনপিকে নাস্তানাবুদ করছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার কাছে দলের সিনিয়র নেতাদেরও আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, আশির দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে রুহুল কবির রিজভীর পরিচিতি থাকলেও বিএনপির রাজনীতিতে অনেকদিন ধরে কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন তিনি। ওয়ান-ইলেভেনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে তিনি ও সমমনারা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কাছাকাছি চলে আসেন। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন থেকেই তিনি দলে নিজের অবস্থান জোরদার করার জন্য পছন্দের মানুষজনকে দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত করে যোগ্যদের দূরে সরিয়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে দিনের অধিকাংশ সময় এমনকি রাতের বেলাও অবস্থান করে দলের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে অন্যদের কোণঠাসা করার ষড়যন্ত্রে বিভোর হয়েছেন। দলকে গোছানোর পরিবর্তে তিনি দলে আধিপত্য তৈরিতে ব্যস্ত থাকছেন। এসব করে তিনি চেয়ারপারসনের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠতে সব ধরনের কর্মকা- করে যাচ্ছেন যা দলকে নানারকম প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে।

দিনের পর দিন রুহুল কবির রিজভীর এ ধরনের অসংলগ্ন কথাবার্তায় দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে দলীয় ফোরাম ও সভায় তাদের বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের ‘বাংলাদেশ : ইমারজেন্সি অ্যান্ড দি আফটার ম্যাথঃ ২০০৭-২০০৮’ বইয়ের কঠোর সমালোচনা করে রিজভী মওদুদ আহমদকে যাচ্ছেতাই ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। সেসময় রিজভী তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘কাক সাতসমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে গেলেও কাকই থাকে। ডিগবাজ, আদর্শহীন ও দলছুট নেতার বইয়ে বিএনপির কিছুই আসে যায় না।’ রিজভী মওদুদ আহমদকে নসিহত করতেও ভোলেননি, বললেন ‘উনি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বই লেখেন না। উনি বই লেখেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে।’

মওদুদ আহমদ তার এক জায়গায় লিখেছেন, ‘ওই সময় খালেদা জিয়া একজন রাজনৈতিক নেতার চেয়ে বেশি করে একজন মা হয়ে উঠেছিলেন। ২০০৭-২০০৮ সালের জরুরি অবস্থার সময় খালেদা জিয়া শুধু তার দুই ছেলের মুক্তি নিয়েই চিন্তা করেছেন।’

রিজভীর এই বক্তব্যের পর মওদুদ আহমদ বিনয়ের সঙ্গে তার উত্তরে বলেছেন, ‘পুরো বইটি হয়ত রিজভী পড়েননি, পড়লে তিনি অনুতপ্ত হবেন। আমি খুব দুঃখ পেলাম। কারণ রিজভীকে আমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো মনে করেছি। তার অনেক লেখাপড়া আছে। তাকে অনেক স্নেহ করি। কিন্তু এখন যা শুনছি, তিনি যে মন্তব্য করেছেন, আমি এটা তো তার কাছে আশা করিনি।’

২. সম্প্রতি বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে দলটির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উপস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয়ে হররোজ সংবাদমাধ্যমে উদয় হওয়া থেকে রিজভীকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করে বক্তব্য দিয়েছেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেছেন, উনি প্রতিদিন স্টেটমেন্ট দিয়ে বেড়ান, কারও সঙ্গে আলাপ না করে ঘোষণা দিয়ে কিছু একটা করে কাগজ ছেড়ে দেন। এত বড় দলের ইয়েকে তো উপদেশ দেওয়া যায় না, এই ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে একটা সুপারিশ করতে পারি। রিজভী সাহেব অনুগ্রহ করে আর প্রেস কনফারেন্স করবেন না, আর প্রেসনোট ছাপবেন না। একই অনুষ্ঠানে বিএনপি সমর্থিত এই বুদ্ধিজীবী রিজভীর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এরশাদ আমলের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে জানান, যখন এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় ছিলেন, তখন উনি প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দায় আসতেন। আমার ছোট মেয়ে ছিল বৃষ্টি। সে বলত যে, বাবা হু ইজ দ্যাট টেলিকাস্টার, হু কামস এভরি ডে। না না, হি ইজ আওয়ার প্রেসিডেন্ট এরশাদ।

পরে এরশাদের সঙ্গে দেখা হলে ৮-৯ বছরের মেয়ের ওই প্রশ্ন তাকে জানিয়েছিলাম এবং এতে কাজ হয়েছিল। এরপর জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, উনার (এরশাদ) বুদ্ধি ছিল বলে এরপর থেকে উনি এত বেশি টেলিভিশনে আসতেন না। দুর্ভাগ্য, বিএনপির মাথায় সেটাও নাই, তারা সবকিছু জানে। জানে।

নিজের নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছা জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এক সদস্য এ ব্যাপারে তার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, দলে নিজের আসন পাকাপোক্ত করতে প্রতিনিয়ত কারণে-অকারণে রিজভীর এ ধরনের কথাবার্তা দলের সাধারণ নেতা-কর্মীর ভেতর তো বটেই, বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল একটি অংশকেও দলটির প্রতি দিন দিন বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে। এই অধিকার তাকে কে দিয়েছে? সম্প্রতি হাওরাঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ে রিজভীর ‘ইউরেনিয়াম’ তত্ত্ব দেশের মানুষকে শুধু বিস্মিতই করেনি, হাস্যরসেরও সৃষ্টি করেছে। স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আরও জানান, বাড়ির কোনো সদস্য যদি অল্প বয়সে পেকে যায় বা ইঁচড়ে পাকা হয়ে যায় তখন সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে সেই বাড়ির অভিভাবকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলের চেয়ারপারসনসহ নীতিনির্ধারক মহল কি এটা বুঝতে পারছেন না রুহুল কবির রিজভীর অবিরাম ‘হাবি-জাবি’ কথামালা বিএনপিকে আস্থা সংকটের তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে? মাহবুব রেজা : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

ইনসার্ট এক প্রতিনিয়ত কারণে-অকারণে রিজভীর এ ধরনের কথাবার্তা দলের সাধারণ নেতা-কর্মীর ভেতর তো বটেই বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল একটি অংশকেও দলটির প্রতি দিন দিন বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে। এই অধিকার তাকে কে দিয়েছে? সম্প্রতি হাওরাঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ে রিজভীর ‘ইউরেনিয়াম’ তত্ত্ব দেশের মানুষকে শুধু বিস্মিতই করেনি, হাস্যরসেরও সৃষ্টি করেছে। স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আরও জানান, বাড়ির কোনো সদস্য যদি অল্প বয়সে পেকে যায় বা ইঁচড়ে পাকা হয়ে যায় তখন সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে সেই বাড়ির অভিভাবকরা।

মাহবুব রেজা : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :