দেশি প্রোডাক্ট বাইরের অনেক দেশের চেয়ে ভালো

প্রকাশ | ০২ মে ২০১৭, ১১:৫৪

সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সিইও, ওয়েল গ্রুপ

শুরুটা চট্টগ্রাম থেকে। এখন রাজধানী ঢাকাবাসীরও মন জয় করে নিয়েছে ওয়েল ফুড। সারা দেশেই সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে তাদের। দেশের খাবার বিপণনে এখন অগ্রগণ্য তারা। এই সাফল্যের পেছনে ভূমিকা রেখে চলেছেন ওয়েল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ নুরুল ইসলাম। এই সময় থেকে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ ঋয়াদ

আপনাদের ফুড প্রোডাক্টগুলো সবাই পছন্দ করছে। এর কারণ কী?

মানুষ আমাদের চেনে ফুড আইটেমের জন্য। কিন্তু আমাদের প্রধান ব্যবসা টেক্সটাইল। টেক্সটাইল ও পোশাক সেক্টরে আমাদের বেশ বড়সড় সেটআপ। প্রাথমিক ধাপ থেকে শুরু করে ফিনিশিং পর্যন্ত পুরো কাজটাই আমাদের এখানে হয়। তারপরও আমরা ফুড সেক্টরে বেশ নাম করেছি। আমাদের ব্যবসার ছোট একটা অংশ হলো ‘ওয়েল ফুড’ এর কনজিউমার পণ্য। কিন্তু মানুষ আমাদের চেনে ওয়েল ফুডের জন্যই। আমি নব্বই ভাগই ফুডের পেছনে সময় দেই। এটা নিয়ে আমাদের সামনে বড় পরিকল্পনা আছে। কারণ ফুডের বাজারটা ক্রমেই বাড়ছে। আমরা সেই বৃহৎ বাজারেরও অংশ হতে চাই। ইতিমধ্যেই নি¤œ-মধ্য আয়ে দেশ চলে গেছে। বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে যাবে। এতে মানুষের ফুড কনজামশনটা দিন দিন বাড়ছে। আমাদের টোটাল টার্নওভারে ফুডের অবদান ১০ ভাগ। কিন্তু আমি আমার সময়ের নব্বই ভাগই দেই ফুডের উপর। কারণ ভবিষ্যতে এর প্রসপেক্টটা বেশ ভালো মনে হচ্ছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ফুড আইটেমও আমাদের টেক্সটাইলের সমান পর্যায়ে যাবে বলে আশা করছি।

এখন আপনাদের কোন কোন খাদ্যপণ্য বাজারে আছে?

আমাদের বেসিক্যালি বেকারী অ্যান্ড কনফেকশনারী আইটেম আছে। বিস্কুট, কুকিজ, ড্রাইকেক, আমাদের সেগমেন্ট অনেক বড়, যেমন আমাদের ব্রেড অ্যান্ড বান আছে। আমাদের ¯œ্যাক্স আইটেম আছে। আমাদের পাউন্ড কেক আছে, ট্রেডিশনাল মিষ্টি আছে, বার্থডে কেক আছে। আমরা মূলত আউটলেট বেইজড ব্যবসা করতাম। আমাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম মিলিয়ে ৪২টা আউটলেট আছে। এ বছর আরো দুটো আউট লেট চালু হবে। আউট লেটের বাইরেও ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলের মাধ্যমে আমরা একটা ব্র্যান্ড লঞ্জ করেছি ‘মর্নিং ফ্রেশ’ নামে। এটাতে মূল টার্গেট হচ্ছে লওয়ার ইনকাম পিপল, অর্থাৎ নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ। এটাকে আমরা ইকোনোমি ব্র্যান্ড বলছি। এটা শুরু করেছি পাঁচ-ছয় মাস ধরে। আমাদের দুই ধরনের ফুড ব্র্যান্ড হলো একটি ‘ওয়েল ফুড’ অন্যটি ‘মর্নিং ফ্রেশ’। আর ওয়েল ফুড হচ্ছে মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য। ওয়েল ফুডটা হচ্ছে আউটলেট বেইজড আর মর্নিং ফ্রেশটা হচ্ছে ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল বেইজড। এটা নিয়ে আমাদের বেশ বড় পরিকল্পনা আছে। আমাদের স্বপ্নও বড়। মানুষের কর্মসংস্থান হবে এখানে।

নিজেদের ফুড আইটেম নিয়ে দর্শনটা কী?

আমাদের এজেন্ডা হলো ‘গুড ফুড এট গুড প্রাইজ’। গুড প্রাইস মানে কম দাম নয় কিন্তু। অর্থাৎ ভালো পণ্য খেতে হলে আপনাকে ভালো প্রাইসও দিতে হবে। আমাদের চিন্তা হচ্ছে কম মূল্যের প্রোডাক্ট বানাব না। লো-কস্ট প্রোডাক্ট বানালে খাদ্যের মান ভালো হয় না। একজন মানুষ কাজ করে খাবারের জন্য। তাই দিন শেষে ভালো এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যই প্রস্তুত করা আমাদের মূল লক্ষ্য।

আপনাদের পণ্যের বিদেশের বাজার কেমন?

আমরা যেহেতু কোয়ালিটি প্রোডাক্ট প্রস্তুত করি। আমাদের প্রোডাক্ট লাইন অনেক বড় নয়। সেই ক্ষেত্রে ভার্সেটাইল কোনো প্রোডাক্ট আমরা বানাই না। এখন পর্যন্ত আমরা যুক্তরাজ্য, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ডসহ আরো বেশ কিছু দেশে ওয়েল ফুডের ফুড প্রোডাক্ট যাচ্ছে। তবে আমাদের এক্সপোর্ট বিশাল আকারে না। কিন্তু আমাদের বিদেশের বাজারও প্রতিদিন বাড়ছে। এক্সপোর্টেরও বড় একটা বাজার বিদেশেও তৈরি হচ্ছে, সেটাকে মাথায় রেখেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

জনসংখ্যার দিক থেকে আমাদের ফুড মার্কেটও তো অনেক বড়।

অবশ্যই জনসংখ্যার দিক থেকে এই মার্কেটটা পৃথিবীর অন্য যেকোনো মার্কেটের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তাই এর গুরুত্বও অনেক বেশি। আর ষোল-সতেরো কোটি মানুষের এই দেশকে যদি মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে এই মার্কেটের ফুড কনজামশন আরো অনেক বেড়ে যাবে।

দেশে খাদ্যাভ্যাসের অনেক পরিবর্তন হচ্ছে, অনেকেই ফাস্টফুডের দিকে ঝুঁকছে, এটাকে কিভাবে দেখেন?

আসলে আমাদের দেশের মানুষ তো এখনো খাওয়া শুরুই করেনি। মানুষ বেসিক ফুডের বাইরে কখন যায়? যখন তার উপার্জন বাড়ে। আমরা এখন নিম্ন-মধ্যবিত্তের দেশ। আমরা এখনো অনেক বেশি ব্যস্ত বেসিক ফুড ডাল-ভাত-মাছের জন্য। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা যদি মধ্য আয়ের দেশে যেতে পারি তাহলে আমাদের ফুড অন্যদিকে ডাইভার্ট হবে। অন্যান্য সৌখিন দ্রব্যের দিকেও নজর বাড়বে। আমরা বেসিক ফুডের বাইরেও খাব, যার লক্ষণ আমরা এখন দেখছি। বিস্কুট, কুকিজের মার্কেট প্রতিবছর অলমোস্ট ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। ফাস্টফুডের বিশাল চাহিদা তৈরি হচ্ছে। কার্বনেটেড ড্রিংকসের ডিমান্ডও বাড়ছে। অর্থনীতির গতির সঙ্গে খাদ্যের অনেক কিছু নির্ভর করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এর সম্পর্কই বেশি। কারণ অর্থনৈতিক গ্রোথ হলে ট্রেডিশনাল ফুডের সঙ্গে অন্যান্য খাদ্যের চাহিদা বাড়ে।

অনেকদিন ধরে ফুড প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছেন, আমাদের দেশের কনজিউমার প্রোডাক্টের মান সম্পর্কে কি বলবেন?

আপনি অতি সম্প্রতি দেখবেন আমাদের দেশের কিছু কিছু প্রোডাক্ট বাইরের অনেক দেশের চেয়ে ভালো। আপনি যদি আপনার কম্পিটিভি মার্কেট দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কথা বলেন, তাহলে বলবো আমাদের প্রোডাক্ট ওদের চেয়ে ভালো। সবকিছু মিলিয়ে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আমাদের প্রোডাক্ট আন্তর্জাতিক মানের। সাম্প্রতিককালে আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে।

আমাদের এখানে ফুড আইটেমের সবই উৎপাদন হচ্ছে, তারপরও বিদেশি বিস্কুট, কেক আমদানি হচ্ছে। কী বলবেন?

আমাদের লোকাল ফুড প্রস্তুতকারকদের কথা মাথায় রেখে সরকার ইমপোর্টেড ফুডের উপর কিছু এক্সট্রা ডিউটি আদায় করছে। ফলে সরকার এসব পণ্যকে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রীকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর কারণে ইমপোর্টেড ফুডগুলোর কস্ট অনেক বেড়ে গেছে। সেটার পেছনে আমাদের উদ্যোগ ছিল। আপনি যদি লোকাল শিল্পকে সাপোর্ট না করেন এখানে শিল্প-কারখানাগুলো দাঁড়াবে না, কর্মসংস্থানও হবে না। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনৈতিকভাবেও দেশ পেছাবে। এসব ভেবেই সরকার দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করছে। সরকার ফুড এবং এগ্রো প্রসেস সেক্টরে আমাদের অনেক সহযোগিতা করছে। এজন্য আমাদের বাজার অনেকটা সংরক্ষিত বলা যায়। এজন্য আমরা এখানে অনেকখানি শ্রম দিতে পারছি।

এই ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের স্বনির্ভরতা কি বেড়েছে?

অবশ্যই বেড়েছে। একটা সময় ছিল আমরা জুসের কথা ভাবলেই বিদেশি জুসের কথা ভাবতাম। এখন আমাদের জুস, আমাদের পানীয় দেশের বাইরে রপ্তানি হচ্ছে। একটা সময় মসলা বলতে আমরা পাকিস্তানি মসলা বুঝতাম। ইন্ডিয়ান মসলা বুঝতাম। অথচ আমাদের মসলা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। বিস্কুট বলতে আমরা মালয়েশিয়ান বিস্কুটের কথা ভাবতাম। এখন আমরা মালয়েশিয়াতে বিস্কুট রপ্তানি করার কথা ভাবছি। আমি মনে করি যে, আমাদের সক্ষমতাটা তৈরি হচ্ছে এগ্রোবেজড ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিতে। এটার জন্য সরকারের পলিসি সাপোর্টকেই আমি সাধুবাদ জানাব।

এই মার্কেটে নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে আসতে চাইলে চ্যালেঞ্জটা কতটুকু?

ব্যবসার পুরোটাই চ্যালেঞ্জ। এখানে চ্যালেঞ্জের বাইরে কোনো কিছু নেই। প্রত্যেক ব্যবসারই নিজস্ব কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। একেকটা একেক রকমের চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের ফুড মার্কেটটা এখনো ভার্জিন। আপনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আপনি মানুষের মন মানসিকতা বোঝেন কি না। দেশের মানুষ কিন্তু খুব কোয়ালিটি সচেতন। আবার প্রাইজ সেনসিটিভ টু। আপনাকে এই মার্কেটে কাজ করতে হলে প্রাইজের কথাও মাথায় রাখতে হবে, আবার কোয়ালিটির কথাও মাথায় রাখতে হবে। প্রাইজ এবং কোয়ালিটি এই দুটোকে মাথায় রেখে আপনাকে নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে আসতে হবে। আপনি প্রাইজের কথা ভাবলেন, কোয়ালিটির কথা ভাববেন না, তা হবে না। মূল চ্যালেঞ্জটা হলো ‘রাইট প্রোডাক্ট এট রাইট প্রাইজ’ করতে পেরেছেন কি না সেটা।

কনজিউমার মার্কেটকে একটি বড় সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা, আপনি কিভাবে দেখেন?

কনজিউমার মার্কেট ডিপেন্ড অন ইকোনোমি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কনজিউমার প্রোডাক্টের কনজামশন নির্ভর করে। আপনার পকেটে টাকা আছে, আপনি ভালো কাপড় কিনতে চাইবেন। পকেটে টাকা আছে ভালো খেতে চাইবেন। সেক্টরটা ডিপেন্ড করে অন্য সেক্টরগুলো ভালো করে কি না এর উপর। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর কনজিউমার প্রোডাক্ট ডেভলাপ করে। এক সময় আমরা ওষুধ খাওয়ার সময় দেখতাম শুধু প্যারাসিটামল। কিন্তু এখন আমরা দেখি এই প্যারাসিটামল কোন কোম্পানির। এটা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই হয়েছে।

সামনের দিনে কি ধরনের পরিকল্পনা?

সামনের দিনে তো পরিকল্পনা থাকবেই, মার্কেট ডিমান্ডের সঙ্গে সংগতি রেখেই প্রোডাক্ট তৈরি করতে চাই। আগামী ছয় মাস পর কী হবে সেটা কিন্তু এখন বলা সম্ভব নয়। ফুড আইটেম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকলে হয়ত আমাদের বড় পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।