মারামারি: দুই যুবককে মাথা ন্যাড়া করে দিলেন চেয়ারম্যান!

প্রকাশ | ০২ মে ২০১৭, ২২:১৮

মহিউদ্দিন মিশু, আখাউড়া থেকে

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় প্রতিবেশী গ্রামের যুবকের সঙ্গে মারামারির অভিযোগ এনে সালিশে দরিদ্র ঘরের দুই যুবককে মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়েছে। শুধু মাথা ন্যাড়া নয়, প্রকাশ্যে জুতাপেটাসহ মারধর এবং একঘরে করে রাখার অভিযোগ উঠেছে দুই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ গ্রাম্য সালিশকারীদের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে বলা হয়েছে তাদের। অন্যথায় তাদের গ্রাম থেকে বিতাড়িত করার হুমকি দিয়েছেন সালিশকারীরা। টাকা না দেয়া পর্যন্ত ওই দুই যুবকের ব্যবহৃত মোবাইলফোন মনিয়ন্দ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের কাছে জমা রাখা হয়েছে।

এই ঘটনায় লজ্জায় ও কষ্টে ওই দুই যুবক আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। জরিমানার টাকা দেয়ার ব্যর্থতায় এক যুবকের দিনমজুর বাবাও আত্মহত্যা করতে গিয়ে প্রতিবেশী দেখে ফেলায় প্রাণে রক্ষা পান।

এ ঘটনাটি ঘটেছে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী মনিয়ন্দ গ্রামে। গত শনিবার এ ঘটনাগুলোর ভুক্তভোগীরা হলেন Ñমনিয়ন্দ ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের আব্দুল বারেক মিয়ার ছেলে পারভেজ মিয়া (১৬) ও পাতাইরাটেক গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে হারুন মিয়া (১৬)। চেয়ারম্যান ও সালিশকারীদের এমন সিদ্ধান্তে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ওই পরিবারগুলো। এলাকার লোকজনও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন সালিশকারীদের ওপর। সালিশকারীদের এ ধরনের অমানবিক ঘটনায় আখাউড়াজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় চলছে।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী রাজমঙ্গলপুর গ্রামের গ্রাম্য চিকিৎসক শাহআলম মিয়ার বাড়িতে গত ছয় মাস আগে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলছিল। একই ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের পারভেজ এবং পাতাইরাটেক গ্রামের হারুনসহ কয়েক যুবক ওই গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে যান। সেখানে অনুষ্ঠানে নাচ করা নিয়ে ওই বাড়ির ছেলে আরিফ হোসেনের (১৬) সঙ্গে ঝগড়া ও মারামারি হয়। ওই মারামারির ঘটনায় হারুন আহত হন। ঘটনার ছয় মাস পর গত ২০ এপ্রিল সকালে আরিফ প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় তাকে একা পেয়ে মারধর করেন হারুন।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ওই ঘটনায় মনিয়ন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল ভূঁইয়া ও গোপিনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মান্নান জাহাঙ্গীর এ বিষয়ে বিচারের সিদ্ধান্তে শনিবার সকালে পার্শ্ববর্তী গোপিনাথপুর ইউনিয়নের নতুন বাজারে সালিশে বসেন। ওই সালিশে স্থানীয় দুই ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি ও সমাজপতিসহ বাজারের শত শত লোকজন উপস্থিত হন। সালিশে পারভেজ ও হারুনের বিরুদ্ধে মারামারির অভিযোগসহ এলাকায় বখাটেপনার অভিযোগ আনা হয়। এক পর্যায়ে জুড়ি বোর্ড গঠন করা হয়। জুড়ি বোর্ডের বিচারকরা হলেন Ñমনিয়ন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল ভূঁইয়া ও গোপিনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মান্নান জাহাঙ্গীর। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা সফিকুল ইসলাম বাবুল মৃধা, জাকির মেম্বার, ফিরোজ মেম্বার, শাহ আলম মেম্বার, এরশাদ মেম্বার, আবু নাসার, শিশু মিয়াসহ আরও কয়েকজনজন ছিলেন জুড়িতে। 

জুড়ি থেকে ফিরে চেয়ারম্যান কামাল ভূঁইয়া ও চেয়ারম্যান মান্নান জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে সালিশের রায়ে সেখানে দুই যুবককে মারধরসহ জুতাপেটা করা হয়। মারধরের সময় ছুটে আসেন দুই যুবকের বাবা কাশেম মিয়া ও বারেক মিয়া। তাদেরও চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এরপর দুই চেয়ারম্যানের নির্দেশে আহত অবস্থায় পারভেজ ও হারুনকে মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। বিচার সেখানেই ক্ষান্ত হয়নি। পরিবার দুটিকে একঘরে রাখার ঘোষণা করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এ ঘটনার খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে গেলে পারভেজের হতদরিদ্র দিনমুজুর বাবা আব্দুল বারেক মিয়া ও হারুনের বাবা কাশেম মিয়া ঢাকাটাইমসকে জানান, সালিশে শত শত লোকের সামনে আমার সন্তানকে জুতাপিটাসহ মারধর করেছেন চেয়ারম্যান কামাল ও মান্নান জাহাঙ্গীর। আহত অবস্থায় তাদেরকে মাথা ন্যাড়া করা হয়েছে। আমাদের আর্তচিৎকারে মন গলেনি সালিশকারীদের। বরং তারা আমাদের ঘাড় ধরে বসিয়ে দেন। সালিশকারীদের পায়ে ধরেও ৫০ হাজার টাকা থেকে কমানো যায়নি। এ ঘটনার পর রাতে লজ্জায়-কষ্টে ওরা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।

মনিয়ন্দ ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সভাপতি শাহীন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক রাজীব ভূঁইয়াসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, তারা ছাত্রলীগের কর্মী। মারামারির ঘটনায় সালিশ দরবারে সবার সামনে জুতাপেটার পর মাথা ন্যাড়া করে চরম অপমান করা হয়েছে তাদের। ঘটনাটি অমানবিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। পরিবার  দুটি এখন ভয়ে আছে। নিজের সমাজের লোকদের এমন আচরণে তারা বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে পড়েছেন।

অবশ্য চেয়ারম্যান কামাল ভূঁইয়া ঘটনা অস্বীকার করে ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমি ওই সালিশে উপস্থিত ছিলাম না। গোপিনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মান্নান জাহাঙ্গীর ওই সালিশ করেছেন। তার নির্দেশে দুজনের মাথা ন্যাড়া করে ছেড়ে দেয়া হয়। এখন দুই চেয়ারম্যান পরস্পরকে দোষারোপ করছেন।

আখাউড়া থানার ওসি মোশারফ হোসেন তরফদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নেয়া হচ্ছে।

আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ শামসুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, কোনো সালিশে জুতাপেটা অমানুষিক ও মাথা ন্যাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ ধরনের কোনো কাজের অধিকার চেয়ারম্যানদের দেয়া হয়নি। ঘটনার খোঁজ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(ঢাকাটাইমস/০২মে/প্রতিনিধি/জেবি)