শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য কি এতই কম?

প্রকাশ | ০৮ মে ২০১৭, ০৮:৪১ | আপডেট: ০৮ মে ২০১৭, ০৯:২৭

জহির রায়হান

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার (এসএসসি) ফল প্রকাশ হয়েছে ৪ মে। এরপরই আশানুরূপ রেজাল্ট না পেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আত্নহত্যার খবর পাওয়া গেছে। কেউ অল্পের জন্য জিপিএ- ফাইভ না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। কেউ বা আবার পরীক্ষায় পাশ না করতে পেরে আত্মহত্যা করেছে বলে জানা গেছে। কিন্ত কেন এমন হচ্ছে? জীবনের মূল্য কি এতই কমে গেছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন কমে যাওয়া, সন্তানদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আশা করা জীবন সম্পর্কে ভালো ধারনা না থাকা, ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা না থাকা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার অন্যতম কারণ।  

ঘটনা ১- রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ না পাওয়ায় দিপু নামের এক স্কুলছাত্র আত্মহত্যা করেছে। দিপু পরিবারে একমাত্র সন্তান ছিলেন। স্থানীয় অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.৯৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়।

ঘটনা ২- রাজশাহীর মোহনপুরে মাহফুজুর রহমান আপেল নামে এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। উপজেলার বাকশিমইল উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৩.৯৫ পায় মাহফুজ।

ঘটনা ৩- ফেনীর ফুলগাজী ও সোনাগাজীতে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করতে না পারায় তাহমিনা আক্তার ও জেসি আক্তার নামে দুই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এদের মধ্যে ফুলগাজীতে পাস করায় এক বান্ধবী তাহমিনার কাছে মিষ্টি পাঠালে অভিমানে তাহমিনা আত্মহত্যা করে। এছাড়া সোনাগাজীতে এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করায় জেসি আক্তার বিষপানে আত্মহত্যা করেন।

ঘটনা ৪- দাখিল পরীক্ষায় পাস করতে না পারায় পিরোজপুরের কাউখালীতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে পলি আক্তার নামের এক মাদ্রাসাছাত্রী। উপজেলার পারসাতুরিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে এবারের দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেয় পলি।

প্রথম ঘটনা দেখা যায় একটুর জন্য জিপিএ-ফাইভ না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনার কারণ আবার ভিন্ন। এক্ষেত্রে রেজাল্ট জিপিএ ফাইভ এর কাছাকাছি ছিল না তারপরও সে আত্মহত্যা করেছে। আর তৃতীয় ও চতুর্থ ঘটনায় দেখা গেল, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে বলে তিন ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, পরিবার অনেক সময় সন্তানদের নিয়ে অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। পরিবার চাপ দেয় সন্তানকে জিপিএ ফাইভ পেতেই হবে। আসলে সন্তানদের প্রতি বাবা-মার সাপোর্টিং কেয়ার নিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে কোন একটি বিষয়ে ব্যর্থতা থাকা মানেই জীবন শেষ নয়। আব্রাহাম লিংকন, ডারউইন, আইনস্টাইনদের মত বড় বড় ব্যক্তিরা কিন্তু শিক্ষাজীবনে খুব সফল ছিলেন তা কিন্তু নয়। এই বিষয়টি শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে। তাদের ভেতর বাস্তবতা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা তৈরী করতে হবে।

ডা. তাজুল ইসলাম আরও বলেন, দেখা যায় কোনো ব্যাপারে সন্তান খারাপ রেজাল্ট করলো, তখন কিন্তু এমনিতেই তার মন ভালো থাকেনা। তার উপর পরিবার থেকে যদি বলা হয় তোমার জন্য এত টাকা খরচ করলাম আর তুমি এ কি করলে! তাহলে সে হতাশ হবে।পরিবার থেকে সন্তানদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিতে শেখাতে হবে।তাদের বোঝাতে হবে জীবন আনেক বড়। আত্মহত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক কাজী তিউনি বিনতে জিন্নাত ঢাকাটাইমসকে বলেন, প্রযুক্তির জন্যই হোক আর সামাজিক পরিবর্তনের জন্যই হোক আজকাল পরিবারের বন্ধন থেকে সন্তানরা দূরে সরে গেছে। এর ফলে তার যখন কোন কিছুতে হতাশ হয়ে পরে তখন তারা ভেবে দেখে আমার তো কোনো পিছুটান নেই। এই পিছুটান না থাকাটাও আত্মহত্যার অন্যতম কারণ।

জিন্নাত বলেন ‘সন্তানদের পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে রাখতে হবে।তারা যেন বুঝতে পারে আমার বাবা আছে, আমার মা আছে, আমার দাদি আছে, আমাকে দেশের জন্য বিছু করতে হবে এই বোধ থাকলে তারা আর আত্মহত্যা করবে না। আবার অনেকের কষ্ট মেনে নেওয়ার ক্ষমতা কম।তারা মনে করে বন্ধুরা, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন এখন কী বলবে? এই মুখ আমি কিভাবে তাদের দেখাবো ইত্যাদি দুশ্চিন্তায় থাকে। ওরা সবাই পেল আমি কেন জিপিএ ফাইভ পেলাম না। অথবা আমি কেন খারাপ করলাম। তাদের বোঝাতে হবে জিপিএ ফাইভ পাওয়াই সব কিছু নয়। বেঁচে থাকলে আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে। বেঁচে থাকার অনেক দাম’।

নাসিমা জামান নামের এক অভিবাবক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি কখনো সন্তানদের পড়াশুনায় চাপ দিই না। এমনকি এসএসসি পরিক্ষা চলাকালীন আমার মেয়ে নাচের অনুশীলন করেছে। আমি দেখলাম সে এটাকে ভালোবাসে। আমি যদি আমার মেয়েকে এখন বকাঝকা করি, সে ভীষণ কষ্ট পাবে। হয়তো এতে ওর পড়াশুনার আরও ক্ষতি হবে। আমার মেয়েকে কখনও বলতে হয়নি তুমি পড়না কেন। এবার পরীক্ষায় আমার মেয়ে জিপিএ-৪.৭৭। আমরা সবাই খুশি। তিনটি বিষয়ে ৭৭ করে পেয়েছে ও। অনেক কান্না করেছে সে। আমি বুঝিয়েছি মা তোমার রেজাল্ট ভালো হয়েছে। পারলে ভবিষ্যতে চেষ্টা করবে আরও ভালো করার জন্য। পারলে পারবে, না পারলে নাই। যদি আমি খুব চাপ দিতাম, বা অতিরিক্ত বকাবকি করতাম, তাহলে আমাদের পরিবারেও দুর্ঘটনা  ঘটতে পারত’।

বেসরকারি চাকরিজীবী হেমায়েত উদ্দিন বলেন, ‘আমার প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ৪ বার পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছিল। সেটা স্বাধীনতার আগের কথা। কিন্তু তিনি আমাদের এলাকার সবচেয়ে ভলো শিক্ষক ছিলেন। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা কয়েকবার পরীক্ষা দিয়ে পাশ না করতে পেরে আবার দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে তাদের কর্মজীবনে সফল হয়েছে। আমি বুঝিনা কেন আজকালকার ছেলে মেয়েরা কথায় কথায় আত্মহত্যা করে। এটা একাটা সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এ সমস্যার  বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে’।

(ঢাকাটাইমস/৮ মে/জেআর/এসএএফ/)