বিকাশে টাকা পাঠিয়ে ধান কাটা শ্রমিক বুকিং

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
 | প্রকাশিত : ০৮ মে ২০১৭, ১২:২৮

‘এক নাগারে ঝড়ি (বৃষ্টি) হয়া ধান মাটিত শুতে গেছে। আধা পাকা ধান কাটলেও সমস্যা, না কাটলেও সমস্যা। কামলাও নাই। অটোরিকশা হয়া মানুষ আর ধান কাটপের আসে না। অটোর ডাইবারি করে। উপায় না পায়া নিজের ধান নিজেই কাটা শুরু করছি। একনা (একজন) করে কামলার দাম ৬০০ টাকা। ভিওত (জমিতে) পানি থাকলে ৭০০ টাকা নেয়।’

উত্তরাঞ্চলের মাঠে মাঠে ঘুরে ধান কাটা মাড়াইয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে এমন চিত্রের কথা বলেন বগুড়া সদর উপজেলার মানিকদাইড় গ্রামের ধানচাষি মন্টু মিয়া। শুধু মন্টু মিয়াই নন, শ্রমিক না পেয়ে হাজারো জমির মালিক দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন। এলাকায় যেসব শ্রমিক আছেন, তাদের অনেককে বুকিং দিতে বিকাশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে টাকা। এছাড়া দেয়া হচ্ছে আসা যাওয়ার গাড়িভাড়াও। জমির মালিকদের বাড়ি পৌঁছলে কৃষকদের চা-মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করানো হচ্ছে। এছাড়া কাজের পর প্রতি সন্ধ্যায় মাছ, মাংস, ডিম, দই, মিষ্টি খাওয়ারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এককথায় কৃষকরা অনেকটা জামাই-আদরের মতো রয়েছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উত্তর জনপদের মাঠে মাঠে এখন শোভা পাচ্ছে সোনালী ধানের শোভা। পাকা ধানের শীষ বাতাসে দোল খাচ্ছে। মাঠের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিজুড়ে ফুটে উঠছে কৃষকের হাসি। সেই হাসি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন কৃষাণ কৃষকের দল। গেল সপ্তাহের প্রায় দিনেই এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসও ছিলো। ধানের শীষ বৃষ্টিতে ভিজে ভারি হয়ে মাটিতে শুছে পড়েছে। এতে কৃষকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুয়ে পড়া ধান পানিতে বেশি থাকলে তা নষ্টের সম্ভাবনা বেশি। এ কারণে আধাপাকা ধানও বাধ্য হয়ে কাটছেন অনেকে। এছাড়া ৮০ শতাংশ পেকে যাওয়া ধানগুলো কাটতে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে কৃষি অফিস। ফলে একসঙ্গে ধান কাটার হিড়িক পড়ায় এসব অঞ্চলে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে।

যেসব জমির মালিক শ্রমিক পেয়েছেন তাদের দিনে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে একজন শ্রমিককে দিতে হচ্ছে। বেশি মজুরির দেয়ার পরেও চাহিদা অনুযায়ী ধানকাটা শ্রমিক মিলছে না। তাই বাধ্য হয়ে অনেক জমির মালিক নিজেই কাঁস্তে হাতে তুলে নিয়েছেন।

কৃষি অফিসের তথ্যানুযায়ী এই অঞ্চলে বর্তমানে পাঁচ লাখ হেক্টর জমির বেশি পাকা ধান মাঠে আছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে আরও পাঁচ লাখ হেক্টর জমির মত ধান একসঙ্গে পেকে যাবে। শনিবার পর্যন্ত রবিবার পর্যন্ত এই অঞ্চলে ৩০ভাগ ধান কাটা হয়েছে। আরও ৭০ ভাগ ধান জমিতে আছে। এতে শ্রমিকের সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।

গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বটতলা বাজার এলাকার বোরো ধানচাষি মোন্তাছির রহমান, আনসার আলী, পচাবস্তা গ্রামের আমজাদ হোসেন জানায়, স্থানীয় তেনাছিরা বিলের বেশিরভাগ ধান মাঠে পেকে আছে। বৃষ্টি বাতাসের আতঙ্কে ভুগছেন এখনকার চাষিরা। তারা বলছে ধানকাটা শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোটায় চলে এসেছে। এই এলাকায় যে কয়জন ধানের কাজ করে তাদের সিরিয়াল পাওয়াই মুশকিল।

এদিকে নওগাঁর আত্রাই, রানীনগর, বগুড়ার নন্দিগ্রাম, কাহালু, আদমদীঘি, দুঁপচাচিয়া, শিবগঞ্জ, সোনাতলা, জয়পুরহাটের কালাই এলাকায় গিয়ে চোখে পড়েছে মাঠের পাকা ধান কাটা নিয়ে কৃষকের করুণ অবস্থা।

গার্মেন্টস ও বিভিন্ন কোম্পানিতে গ্রামের হাজার হাজার অশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিতদের কর্মসংস্থান হওয়ার ধানকাটা শ্রমিক সংকটের কারণ বলে জানান কৃষকরা। এছাড়াও গ্রাম শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা-ভ্যান সহজলভ্য হওয়ায় এসব চালানোর দিকেই ঝুঁকে পড়েছে বেশিরভাগ শ্রমিক।

কথা হয় বগুড়া শহরের অটোচালক ইব্রাহিম হোসেনের সঙ্গে। তিনি সারিয়াকান্দি উপজেলার বাসিন্দা। এক বছর আগেও ধানের সিজনে মাঠে ধান কাটার কাজ করতেন তিনি।

ইব্রাহিম জানান, ‘ধান কাটা কামে অনেক খাটুনি। রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠোত কাম করতি হয়। তার চায়া অটোরিকশা চালানো অনেক সহজ। এছাড়া আয়-ইনকামও বেশি।’

অপরদিকে মাঠে ধানকাটা শুরু হওয়ার পাশাপাশি চালু হয়েছে হাসকিং চালকল গুলো। মিলে চাল যাওয়া চাতালগুলো সরব হয়ে উঠেছে। এই চালগুলোতেও একটা বড় অনেক শ্রমিক কাজ করে। মাঠের পাশাপাশি চাতালগুলোতে শ্রমিকের সংকট সমান আকারে দেখা দিয়েছে।

দুপচাঁচিয়া উপজেলা চাতাল মালিক সমিতির সভাপতি মোবারক হোসেন, চাতাল মালিক আবু কালাম আজাদ জানান, গত তিন চার বছর ধরে ভরা মৌসুমে তারা শ্রমিক সংকটে ভোগেন। এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী তারা উৎপাদন করতে পারেন না। এর ফলে অনেক সময় লোকসানের শিকার হতে হয়।

তারা আরও জানান, মৌসুম শুরু হওয়ার এক মাস আগেই শ্রমিকদের অগ্রিম টাকা দিয়ে বুক দিতে হয়। এখানে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা, নলডাঙ্গা, রংপুরের পীরগাছা, চৌধুরানী এলাকার শ্রমিকরা কাজ করে। বর্তমানে চাতাল শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক কমেছে।

২০ বছর আগে উত্তরে মোট কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো ৮০ লাখের বেশি। এখন নিয়মিত কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা নেমে এসেছে ১০ লাখে। এই ১০ লাখ শ্রমিকের অর্ধেক দেশের পূর্ব, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে বোরো কাটা মাড়াইয়ের কাজে গেছে। ফলে মাত্র ৫ লাখ শ্রমিক এখন কাজ করছে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাজুড়ে।

বিগত কয়েক বছরের মধ্যে কৃষকরা ভরা মৌসুমে ভালো দাম পায়নি। এবার ধানের বাজারের দৃশ্য ভিন্ন। উত্তরের বিভিন্ন জেলার হাট বাজারের চিকন ধান কাচা ৮০০ টাকা মণ, শুকনা ৯০০-৯৫০ ও মোটা ধান কাচা ৬৫০ টাকা মণ, শুকনা ৭০০-৭৫০ দরে বিক্রি হচ্ছে।

উত্তরাঞ্চলের প্রধান ফসল বোরো ধান। প্রায় ৫৬ লাখ কৃষক পরিবার এই ফসলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। বোরো চাষের উপর নির্ভর করে এই অঞ্চলের অর্থনীতি।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বগুড়া আঞ্চলিক অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক (ভার.) জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার ধান কোন অংশে কম হয়নি। কৃষি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারিদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে কৃষকরা ভালো ফলন পেয়েছে।

তিনি জানান, যেসব জমিতে ৮০ ভাগ পেকেছে এমন ধান কাটার জন্য কৃষকদের পাইকং লিফলেট দিয়ে জানিয়েছে। কৃষকরা অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী মাঠে কাজ করছে।

ঢাকাটাইমস/৮মে/প্রতিনিধি/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :