বিমানবন্দর সড়কে ‘আসল’ গাছের জায়গায় ‘নকল’ গাছ
রাজধানীর ব্যস্ততম বনানী ওভারপাস টু এয়ারপোর্ট সড়কের শোভাবর্ধনের জন্য ‘আসল’ গাছ কেটে ‘নকল’ গাছ লাগানোর অভিযোগ উঠেছে। ভিআইপি এ সড়কের ধারের কৃষ্ণচূড়া, রাঁধাচূড়া এবং অন্যান্য নানান জাতের গাছ কেটে বিদেশ থেকে আমদানি করা বনসাই গাছ লাগানো হয়েছে। এতে রাস্তার ধারের সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হয়েছে সে প্রশ্নতো উঠেছেই, উপরন্তু সবুজায়ন এবং অক্সিজেন সরবরাহ করার সক্ষমতা এ গাছগুলোর আদৌ আছে কি না তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। বড় বড় দেশি গাছ কেটে আমদানি করা ১২-১৫ ফুট উচ্চতার বনসাই গাছ লাগানোর ফলে এ প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরও।
সম্প্রতি এয়ারপোর্ট থেকে বনানী ওভারপাস পর্যন্ত সড়কটির সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে গত একমাস ধরে চীন থেকে আমদানি করা বনসাই গাছ লাগানো হচ্ছে। এরমধ্যেই প্রায় ৯৬টি গাছ লাগানো হয়ে গেছে। এই সড়কটিতে এমন আরও এক হাজার বনসাই গাছ লাগানো হবে। এয়ারপোর্টের বিপরীত দিকের দেশি গাছগুলো এর মধ্যেই কেটে ফেলা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, নতুন গাছ লাগানো হচ্ছে তাই পুরানো গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। সড়কের পশ্চিম দিকের গাছগুলো অবশ্য এখনো আগের মতোই রয়েছে। তবে সেগুলোও পরবর্তী সময়ে কেটে নতুন গাছ লাগানো হবে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সড়ক ও ফুটপাতের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজটি মূলত সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধানে বনানী ওভারপাস টু এয়ারপোর্ট বিউটিফিকেশন প্রকল্পের আওতায় করা হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সৌন্দর্যবর্ধনের এই কাজটি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা হয় ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপের স্বত্বাধিকারী আবেদ মনসুরের সাথে। আসল গাছ কেটে নকল বিদেশি বনসাই গাছ কেন লাগানো হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে আবেদ মনসুর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আসলে আমরা পুরানো কোনো গাছই কাটিনি। এয়ারপোর্ট অংশের যে জায়গাটিতে বনসাই লাগানো হয়েছে সে জায়গার পেছনের অংশে রাস্তার কাজ করার সময় অল্প কিছুসংখ্যক গাছ কেটে রাস্তাটি বড় করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সেটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধানেই হয়েছে। কিছু গাছ ঝড়ের কবলে পড়ে ভেঙে গেছে।’
কিন্তু দেশি গাছ রেখে বিদেশি গাছ, তাও বনসাই, লাগানোর কারণ কী? এর উত্তরে তিনি জানান, এই প্রকল্পের আওতায় বনানী ওভারপাস থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। আর মোট গাছের মাত্র ১০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। বাকি সবই বিভিন্ন জাতের দেশীয় গাছ লাগানো হবে। কৃষ্ণচুড়া, রাঁধাচুড়া, জারুল, কাঠ বাদাম, কদম, শিমুল ইত্যাদি বড় আকৃতির গাছ লাগানো হবে যাতে চলার পথে সাধারণ মানুষ শীতল ছায়ায় বিশ্রাম নিতে পারে। বনসাই ছাড়াও সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হবে বাহারি পাতাবাহার। রঙিন পাতাবাহর এনে রাস্তাগুলোকে আরও সুন্দর করা হবে। এসব গাছ থেকে পর্যাপ্ত অক্সিজেনও পাওয়া যাবে। আর বনসাই গাছটি বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও সেটা দেশীয় জাতেরই বনসাই। শুধুমাত্র আকৃতি ও ডিজাইনকে প্রধান্য দিয়ে এসব বনসাই আমদানি করা হয়েছে যাতে রাস্তার দুই পাশ দেখতে সুন্দর হয়।
অবশ্য ভিনাইল কর্তৃপক্ষের এ ব্যাখায় সন্তুষ্ট নন অনেকেই। আর এ ধরনের বেমানান এবং ক্ষতিকর সৌন্দর্যবর্ধনের যথার্থতা নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন তারা। আরবান অ্যান্ড রুরাল প্লানিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আকতার মাহমুদ তার ফেসবুক পেজে লিখেন, ‘এয়ারপোর্ট রোডে সৌন্দর্য বর্ধনের নামে যে বেমানান প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে তা নিয়ে মানুষ যে ক্ষোভ প্রকাশ করছে তা অত্যন্ত ন্যায্য।
সবার মতো আমারও বিস্ময়ের শেষ নেই, কেমন করে এমন একটা নির্বোধের মতো কাজ করা হলো। মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই রাস্তার দুইপাশে নানা জাতের নানা রঙের ফুল ফুটে থাকত। জারুল, সোনালু, রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়ার বাহারি ফুল সবাইকে মুগ্ধ করতো। যারা উত্তরা এলাকায় থাকে তারা সকাল-বিকাল আসা যাওয়ার পথে এই ফুলগুলো দেখতে পেতেন। এখন এই ভিনদেশী কদাকার গাছগুলো দেখতে হবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিদেশি মেহমানরা বাংলাদেশে আসলে মূলত এই সড়ক দিয়েই প্রবেশ করে। এই সড়কের পাশের ময়লা আবর্জনা ও ঝোপ-ঝাড় ছাঁটাই করে পরিচ্ছন্ন ডিজিটাল সড়ক হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। আর বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে পজিটিভ ধারণা দিতেই সড়কটিকে নতুন আঙ্গিকে সাজানো হচ্ছে।’
শহরের সবুজায়নে ধরনের প্রকল্পের কোনো ভূমিকা আদৌ আছে কি না সে প্রশ্নের জবাবে আবেদ মনসুর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আসলে রাতারাতি পুরো শহরকে সবুজময় করে তোলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আমরা এই ছয় কিলোমিটার সড়ককে সবুজময় করে তোলার চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়েছি। আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখেছি। সেখানে আমাদের দেশের মতো পরিকল্পনাবিহীন গাছ লাগানো হয় না। আমি চীন, তাইওয়ান ও হংকংয়ের জঙ্গল ঘুরে বড় আকারের এসব বনসাই গাছ নিয়ে এসেছি। আমরা এই সড়কটিকে সবুজময় করে তুলবো, কিন্তু সেজন্য কিছুটা সময় দরকার। ইতিমধ্যেই আমাদের রোপন করা বনসাইগুলো সবুজ পাতা দিতে শুরু করেছে। আগামী দুই থেকে তিন মাস পরিচর্যা করলে সড়কের ধারে লাগানো বনসাইগুলো আরও দৃষ্টিনন্দন ও সবুজ পাতায় ঢেকে যাবে। তখন আর কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারবে না আশা করি।’
দেশি গাছের বদলে বিদেশি বনসাই লাগানো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে, এ নিয়ে আবেদ মনসুর সকলের সহযোগিতা চেয়ে বলেন, ‘ভালো কাজ করতে গেলে দুই চারজন সমালোচনা করবেই। আমরা লোক দেখানো কোনো কাজ করছি না। আমাদের এসব কাজ দেখে অনেকেরই গাত্রদাহ হচ্ছে। আমাদেরকে কিছুদিন সময় দিন, আমরা ওয়াদা করছি এই সড়কটিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন সড়ক হিসেবে গড়ে তুলবো।’
(ঢাকাটাইমস/২০মে/আইআর/কেএস/জেবি)