ফারুক চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা থেকে যাবে সব সময়

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
| আপডেট : ২০ মে ২০১৭, ১১:৩৩ | প্রকাশিত : ২০ মে ২০১৭, ১১:১৪

১৭ মে বুধবার সকালে লন্ডন থেকে বড় ভাই টেলিফোন করে ফারুক আহমেদ চৌধুরীর ইন্তেকালের সংবাদ জানালেনl বেশ কয়দিন থেকেই তিনি অসুস্থ ছিলেনl হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলl কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যেতে হলl

১৭ মে বুধবার ভোর চারটায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফারুক চৌধুরী (ইন্নালিল্লাহি..রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। পরিবারে এখন রয়েছে স্ত্রী মেয়ে ফারজানা ও ছেলে আদনানl

ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে তার সামনাসামনি দেখা হয়েছে মাত্র দুইবারl একবার ১৯৮৪ সালে আমার দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে সহযোগিতার জন্য ঢাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলামl তখন তিনি ছিলেন পররাষ্ট্র সচিবl আমার সামনেই সরাসরি টেলিফোন করলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব আবু হেনার কাছেl বললেন, ‘হেনা আমার ভাগ্নাকে পাঠাচ্ছিl ওর দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়টা একটু দেখোl আমি এখনই ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর তার বাসভবনেl বঙ্গবন্ধুর বাসা ছেড়ে কয়েকটি বাসার পরেই একটি দোতলা বাড়িতে থাকতেন তিনিl এই সময় একদিন সকালে একসাথে নাস্তা করতে করতে একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলামl

ফারুক আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে ১৯৭৭ সালে আমার প্রথম সরাসরি টেলিফোনে কথা হয়l তিনি তখন আবুধাবিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেনl এই সময় আমি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের ভয়ে দেশ থেকে পালিয়ে ইরানে অবস্থান করছিলামl তেহরান থেকে সরাসরি আবুধাবিতে টেলিফোনে কথা হয়l

বললাম, ‘আমি আবুধাবিতে আসতে চাই।’ সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী?’। বললাম, ‘বি এ পাস।’ তিনি বললেন, ‘আসতে পারো, তবে তোমার এই শিক্ষায় গাড়ি পরিস্কার, ফুলের বাগানে পানি বা ঘর বাড়িতে কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ পাবে নাl তার চেয়ে ভালো ইউরোপের অন্য কোনো দেশে যেতে চেষ্টা করো।’

ইউরোপের অনেক দেশে তখনও বাংলাদেশের ভিসা হয়নিl এখনও আমার মনে পরে ওনার সহজভাবে আমাকে দেওয়া এই উপদেশের কথাl

ফারুক আহমেদ চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু খুব পছন্দ করতেনl তিনি নিজেও বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেনl আজকে যেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যালয় অবস্থিত এই ভবনটি তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস করার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেনl বাবা গিয়াসউদ্দীন চৌধুরীর সাথেও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলl আমার সাথে সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের, ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বিষয়ক প্রশ্ন উঠে আসলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াl শুধুমাত্র রেডিওতে ঘোষণা দিয়েই একটি দেশকে স্বাধীন করা যায় নাl বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ধাপে ধাপে এগিয়ে এনেছেন এবং পরবর্তীতে একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ও সবশেষে ২৬ মার্চ দিবাগত রাত্রে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’

ঢাকার একসময়ের বিভাগীয় কমিশনার গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর চার ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে ফারুক আহমেদ চৌধুরী ছিলেন সবচেয়ে বড়l পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় তার চাকরি জীবনl পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও সবশেষে পররাষ্ট্র সচিব পদ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেনl

১৯৮৬-১৯৯২ পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেনl একসময় তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেনl বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন প্রথম ঢাকায় অবতরণ করেন ওই সময় একই বিমানে তিনি নেতার সহযাত্রী ছিলেনl তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অতি ঘনিষ্ঠ প্রিয় পাত্র ছিলেন।

ফারুক চৌধুরীর লেখালেখির অভ্যাসও ছিলl ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেনl ব্যক্তিগতভাবে আমি এই পরিবারের তিন জন অর্থাৎ ফারুক আহমেদ চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরী ও ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিl পরিবারের আরেক ভাই মাসুম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়েছে বলে মনে পরে নাl তবে শুনেছি বাংলাদেশ দূতাবাস পাকিস্তানে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনের পর পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েনl পরবর্তীতে মাসুম আহমেদ চৌধুরী আমেরিকায় ইন্তেকাল করেনl

ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ ডক্টর ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী পররাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেনl এই সময় তিনি স্টকহল্ম ভ্রমণে এলে আমার বাসায় তার একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করিl ডক্টর ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও পালন করেনl বর্তমানে সিঙ্গাপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন বলে শুনেছিl

ইনাম আহমেদ চৌধুরীর সাথে ১৯৬৪ সালে সিরাজগঞ্জে প্রথম দেখা হয়l এই সময় তিনি সিরাজগঞ্জের এস ডি ও ছিলেনl ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে স্টকহলম সফরে আসলে দ্বিতীয়বার দেখা হয়l তৃতীয়বার যখন দেখা হয় তখন আমি তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলামl এইসময় তিনি বিএনপি সরকারের মন্ত্রীl পরবর্তীতে দেশে গেলে দেখা হয়েছে অনেকবারl কয়েক বছর আগে একবার স্টকহল্মে আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেনl

বঙ্গবন্ধু প্রেমিক প্রত্যয়দীপ্ত ফারুক চৌধুরীর আজ আর আমাদের মাঝে নেইl আত্বীয়তার সূত্রে তার কাছ থেকে যে স্নেহ ও ভালোবাসা আমি পেয়েছি এ জন্য কৃতজ্ঞ। সেদিনের তার এই উপদেশ দিয়েছে আমাকে ইউরোপে আসার প্রেরণাl আজ আমি সুইডেনে স্থায়ী বাসিন্দাl স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে সিলেট থেকে উদ্ভাসিত যে কজন মানুষ স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজ কর্মদক্ষতায় পরিচিতি অর্জন করেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন ফারুক আহমদ চৌধুরী।

ফারুক মামার মৃত্যুতে আমি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: সুইডেনে মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :