কাকতালীয় শোধ
জাকারিয়া দাঁড়িয়ে আছে বলাকা সিনেমা হলের সামনে। চারপাশে প্রচুর মানুষের আনাগোনা। সে এখানে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে অবস্থান করছে না। মুভি দেখার অভিপ্রায়েও আসেনি। আপাতত সে বেকার। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ছেলে। পড়াশুনায় খুব ভালো এবং ভালো রেজাল্ট করেই সে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। খোঁয়াড় থেকে হাঁস-মুরগিকে বের করে দিলে তারা যেমন ভেবে কুল পায় না- অবারিত এই স্বাধীনতায় কোন দিকে যাবে! জাকারিয়ার অবস্থাও অনেকটা সেরকম। চঞ্চল, অস্থির- ম্যাচিউরিটির আসি আসি ভাব। সময় কাটানো নিয়ে সে বেশ দুশ্চিন্তায় থাকে। সময়টা যেন আপাত চমৎকার কেটে যায় সেজন্য পার্টটাইম প্রেম করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভাগ্যের শিঁকে ছিঁড়েনি। এখনও পথে প্রান্তরেই ঘুরতে হচ্ছে।
জাকারিয়া সিনেমা হলের ফটক অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করে। ভবঘুরের মতো এখানে ওখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। বাদাম চিবোয়। সে খেয়াল করেছে, মুখ ব্যস্ত থাকলে বেকার সময়টা তাড়াতাড়ি কেটে যায়। হলে ঢালিউডি একটা মুভি চলছে। পোস্টারে নায়িকার বুকের গভীর খাঁজ দেখে সে পুলকিত হয়। টিকেট কেটে সিনেমাটা মানে নায়িকাকে দেখে আসবে কিনা ভাবছে! তিন ঘন্টার জন্য সময় পার সেই সাথে জীবনের নির্মম বাস্তবতায়ও প্রবেশ করা যাবে। জাকারিয়া মনে হয় মত পরিবর্তন করেছে। কারণ কাউন্টারের দিকে না গিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে পিলারের সামনে দাঁড়ানো এক অষ্টাদশীর দিকে। গোবেচারা ভাব নিয়ে সে মেয়েটির সামনে নতজানু হয়।
‘আপু অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি- আপনি একা দাঁড়িয়ে আছেন।’
মেয়েটি চোখ ছোট করে জাকারিয়ার দিকে তাকায়- তাকে চেনার চেষ্টা করে। তার মস্তিষ্ক অধিক সক্রিয় করে, আতিপাতি করে খুঁজেও যখন দেখলো মেমোরিতে কিছু ভাসেনি- তখন কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।
‘আপু, আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন!’
‘আপনি কে!’
‘আপনার কি বয়ফ্রেন্ড আছে!’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে বয়ফ্রেন্ড আসাতক আপনাকে সময় দেই! আপনার বোরিং ভাবটা কেটে যাবে।’
‘এই দিপু। এদিকে আয়তো!’
‘কি হইছে, শিলা!’
মেঘের গর্জনের মতো কন্ঠ। কালা জাহাঙ্গীর টাইপ এক ছেলে এসে হাজির। আর জাকারিয়া দাঁত বের করে হাসছে। কেলানো কণ্ঠে বলে, ‘ভাইজান , আপনি কি ওর বয়ফ্রেন্ড!’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি এতক্ষণ ওনাকে পাহারা দিয়ে রেখেছি। আপনি এসেছেন- আমার দায়িত্ব শেষ। আমি তাহলে এখন আসি।’
জাকারিয়া সামনের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু কালা জাহাঙ্গীর মানে কথিত দিপু তার জামার কলার টেনে ধরে গতিরোধ করে।
‘ঘটনা কি শিলা বলতো!’
‘এই ছেমরা আমাকে ইভ টিজিং করছে। আমারে ইয়াবা সাধে।’
প্রথমে ঠাস ঠাস করে শব্দ। তারপরে বিরামহীন কয়েকটি কিল-ঘুষি। বেচারা জাকারিয়ার নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত ঝরছে।
‘দিপু, হয়েছে থাক। এবার ওকে ছেড়ে দে।’
‘তার আগে বল, তোর গায়ে হাত দিছে কিনা!’
‘না না। ওসব কিছু করেনি।’
এরইমধ্যে আশপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছে। সবারই হাত নিশপিশ করছে। দিপু বরং এবার জাকারিয়াকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।
‘শিলা, তোর জুতাটা খুলে হাতে নে।’
‘কেন!’
‘যা বলছি কর। নাইলে কিন্তু ওরে হায়েনার সামনে ছেড়ে দিবো।’
শিলা বাধ্য মেয়ের মতো এক পাটি জুতা খুলে হাতে নেয়। আগুন্তুকের পরিণতির কথা ভেবে সে ভীত।
‘হারামজাদার গালে, জুতা মার তালে তালে।’
আবারো ঠাস ঠাস শব্দ। দিপু এবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে জাকারিয়াকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। জাকারিয়া হাঁটছে- তার নাক বেয়ে ঝরে পড়া রক্ত- পথ ভিজিয়ে যেন কোনো নিশানা তৈরি করছে।
মাস ছয়েক পরের কথা। জাকারিয়া এসেছে নিউমার্কেটে। তার একটি হ্যান্ডব্যাগ কেনা প্রয়োজন। বেশ কয়েকটি ব্যাগের দোকান সে ঘুরেছে। কিন্তু এখনও পছন্দ করতে পারেনি। সে ঠিক করেছে- আর মাত্র একটি দোকানে সে যাবে। পছন্দ না হলে আরেকদিন- অন্য কোথাও। ফি আমানিল্লাহ বলে সে বাম সারির একদম শেষের দোকানটিতে প্রবেশ করে। ব্যাগ একটা তার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু দোকানদার দাম হাঁকায় তেরশ টাকা। এই ছোট ব্যাগের দাম তেরশ টাকা! তার মেজাজ বিগড়ে যায়। সে কোনো রকমে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত বলতে পারে। ভাব নেয় দোকান থেকে বেরিয়ে আসার। তার মনে আশা, দোকানদার তার এই অবিচলতা দেখে পাঁচশ টাকাতেই ব্যাগ দিয়ে দিবে। শেষ ভরসা হিসেবে সে দোকানের ফটকে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ায়। না, কেউ তাকে ফেরায়নি- বলেনি, নিয়ে যান। ব্যাগটি কিন্তু তার বেশ পছন্দ হয়েছিলো।
দোকানদারের উপর অভিমান করে জাকারিয়া বের হয়ে এসেছে। মার্কেট ঘুরে ঘুরে তার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু খাবারের দোকানগুলোতে এসে এক বিড়ম্বনা- তাকে নিয়ে টানাটানি। ধমকি দিয়ে তাদেরকে নিবৃত্ত করে নিজের পছন্দ মতো একটা দোকানে এসে বসে।
জাকারিয়ার সরকারি চাকরি হয়েছে। সে এখন সরকারি কর্মকর্তা। আর কিছুদিন পরেই চাকরিতে যোগদান। নিউমার্কেটে আজ এসেছিলো একটা অফিসিয়াল ব্যাগ কিনতে।
জাকারিয়া মেন্যুতে চোখ বুলায়। কি অর্ডার করবে বুঝতে পারছেনা। আশপাশে মানুষজন কি খাচ্ছে, তা দেখার চেষ্টা করে। সামনের টেবিলে তার দিকে পিছন ফিরে বসেছে দুই মেয়ে আর তাদের সামনে এক কিশোর। যে মেয়েটি ছেলেটেিক বলছে- কি খাবে তুমি! কন্ঠটা জাকারিয়ার কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে। জাকারিয়া তার স্মৃতি হাঁতড়ে বেড়ায়। মস্তিষ্কের সেলগুলোকে সে পুরোদমে সচল করে।
‘না আপু আমি কিছু খাবো না।’
‘ কিছু খাও। এত করে বলছি।’
জাকারিয়া মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটি তাকে দেখে চমকে উঠে। কিন্তু জাকারিয়ার কন্ঠ স্বাভাবিক।
‘ইয়ে আপু, উনি যদি খেতে না চান, তাহলে তার ভাগেরটা আমাকে দিয়ে দেন। আমার পয়সা খরচ করার কি দরকার! ওর জন্য তো আপনার বাজেট ধরাই আছে।’
মেয়েটি হাসবে নাকি কাঁদবে কিছু বুঝতে পারছেনা।
‘আপনার গালের দাগটা এখনও রয়ে গেছে দেখছি। মিলায়নি।’
‘আপনি সেদিন মেডিকেল খরচ না দিয়ে চলে গেলেন! দামি ক্রিম লাগাইতে পারি নাই।’
মেয়েটি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জাকারিয়াকে বলে, ‘আপনি ওখানে গিয়ে বসুন। কি খাবেন, অর্ডার দিন। আমি বিল দিয়ে যাবো।’
এর কয়েকদিন পরে, সময়টা তখন জানুয়ারি ২০১৫। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। মুড়ি মুড়কির মতো এখানে সেখানে ককটেল, বোমা ফুটছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় মানুষের স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে লোকজন অপারগ না হলে ঘর থেকে বের হচ্ছেনা। যা তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে। এই আন্দোলনের কারণ সরকারি দলের একতরফা নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠান। বিরোধীদলের আন্দোলনের উদ্দেশ্য, সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানো। সেজন্য তারা বেছে নিয়েছে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যম। বাসে পেট্রোল বোমা মেরে পুড়িয়ে সাধারণ মানুষ হত্যা। জানমালের ক্ষতিসাধন। সাধারণ জনগন কিন্তু এই সহিংস আন্দোলনকে সমর্থন করছেনা। তারা হানাহানির রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা চায় শান্তিপূর্ণ সমাধান। সুতরাং জনগনকে সাথে নিয়ে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন এখানে ফলপ্রসূ হচ্ছেনা। দগ্ধ মানুষজনের হাহাকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। জাকারিয়া নিজেও এই সহিংস আন্দোলনকে সমর্থন করেনা। তার আশেপাশে কোনো হামলার ঘটনা ঘটলে, সে দুস্থদের সেবায় এগিয়ে যায়। কয়েকদিন আগেও সে অগ্নিদগ্ধ পোড়া এক মহিলাকে নিজদায়িত্বে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে। তার প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে এবং এ ঘটনায় ব্যথিত হয়েছে। তবে জাকারিয়ার এটা নিজস্ব অভিমত যে, এই আন্দোলন খুব সহসাই থেমে যাবে। কারণ এতে জনসমর্থন নেই। দেশের জনগন যদি কোনো ইস্যুতে এক হয় তবে অস্ত্রের প্রয়োজন হয়না। যেটা সে লক্ষ্য করেছে, তাহরির স্কয়ারে। জনগন, জনগনের শক্তি অসীম। যে কোনো অশুভ শক্তিকে এর কাছে মাথা নোয়াতে হবেই। সুদূর তাহরির স্কয়ারে যেতে হবেনা। জাকারিয়ার মনে পড়ে যায়, ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের কথা। জনগনের মিলিত শক্তি, পারস্পারিক দ্বন্ধ ভুলে অভিন্ন স্বার্থে জোট গঠন স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ককে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছিলো। জাকারিয়া মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, এদেশের মানুষ স্বৈরাচার, গনতন্ত্রহীনতা, জঙ্গিবাদ, বাক স্বাধীনতার হরণ- কখনোই মেনে নিবেনা। কারণ এদেশের মানুষের আছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। সেসব ছিলো আরোপিত অন্যায্য সিদ্ধান্ত, বৈষম্য ইত্যাদির প্রতিবাদ।
জাকারিয়া গ্রামের বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে এ্যালিফ্যান্ট রোডে এক কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে এসেছিলো। বাড়িতে থাকে তার বাবা- মা আর ছোট বোন। জাকারিয়া কয়েকটা টিউশনি করে। এটি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই। তার নিজের হাত খরচ বাদেও কিছু টাকা রয়ে যায়। সেটি সে ছোট বোনের পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহের জন্য পাঠিয়ে দেয়। তবে এমাসেই এসব টিউশনির ইতি ঘটতে যাচ্ছে। তার পরিবার মোটামুটি সচ্ছল। তার বাবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়িও এই বিদ্যালয় দিয়েই। স্কুলে জাকারিয়ার জীবনের কিছু স্মরনীয় মূহুর্ত আছে। সেই স্মৃতিগুলো তাকে ভীষণভাবে আমোদিত করে। সে যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, বাবার সাথে তার একটি ক্লাস পড়ে যায়। বাবা শিক্ষক ছেলে তার ছাত্র। সেটি বাড়িতে নয়, একটি প্রতিষ্ঠানে। যেখানে শিক্ষককে অবশ্যই স্যার বলে সম্বোধন করতে হয়। জাকারিয়া পরে জেনেছে, তার বাবা খুব অনিচ্ছুক ছিলো এব্যাপারে। তৎকালীন হেডমাস্টারের চাপে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। স্কুলের অন্য সবাই দেখতে চেয়েছিলো, বাপ- ছেলের ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক। তার অবশ্য এসব নিয়ে কোনো বালাই ছিলোনা। বাবার ক্লাস করতে তার ভালোই লাগতো। সবচেয়ে মজা হতো বাবা যখন পড়া জিজ্ঞেস করতো। ক্লাসের অন্যরা মুখ হা করে মনোযোগি হয়ে থাকতো- যদি তার কোনো ভূল ধরা পড়ে। সেক্ষেত্রে তাদের দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো- বাবা আমাকে কি শাস্তি দেয়! কিন্তু তাদের সে ইচ্ছা কখনও পূরণ হয়নি। কারণ, বাবা এ ব্যাপারে ছিলেন খুব সতর্ক। তার ক্লাসের পড়া মা আমাকে সবার আগে শিখাতেন। আর বাবা তাকে বলে দিয়েছিলো- অন্য ক্লাস বাদ দিয়ে হলেও আমি যেন তার ক্লাসের পড়া অবশ্যই শিখে যাই। প্রথম প্রথম ক্লাসের মধ্যেই জাকারিয়া তার বাবাকে বাবা বলে ডেকে ফেলতো। আর এ নিয়ে ক্লাসের মধ্যে হাসির রোল উঠতো। আর এই সরস ঘটনাটা পুরো স্কুলে ছড়িয়ে যেতো খুব দ্রুত। তার নিজের এই অভ্যাসটা পরিবর্তনে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিলো। তার বাবা এমনিতে অন্য ক্লাসে ছাত্র পেটালেও ঐ একবছর তিনি এই ক্লাসের কোনো ছাত্রকে পেটাননি। বলা যায় তিনি খুব বিব্রতই বোধ করেছেন ঐ একটা বছর। যা হোক তার বাবাকে মুক্তি দিয়ে- প্রাইমারির পাঠ চুকিয়ে, পরের বছর সে অন্য স্কুলে ক্লাস সিক্স এ ভর্তি হয়।
জাকারিয়া কুরিয়ার সংক্রান্ত কাজ শেষ হতে বেশি সময় লাগেনা। কারণ মানুষজন তেমন নেই। অন্যসময় হলে লাইনে দাড়াঁতে হতো। কমপক্ষে আধাঘন্টার মামলা। এখান থেকে তার বাসার দূরত্ব খুব বেশি দূরে নয়। হেঁটে এসেছিলো, হেঁটেই চলে যাবে, ভাবছে। মাঝামাঝি দূরত্ব সে অতিক্রম করছে। তখনই বোমা বিস্ফোরণের গগন বিদারি শব্দ। ঘটনাটি জাকারিয়ার এত নিকটে ঘটে-সবকিছু তার কাছে অনেকটা ঢালিউডি মুভির মতো লাগছে। সে অবশ্য অক্ষতই আছে। নিজেকে সে এই মুহূর্তে হিরো হিসেবে কল্পনা করে। যার দায়িত্ব হতাহতদের সেবায় এগিয়ে যাওয়া। মানুষজন যে দিকে পারছে, পালাচ্ছে। আহত কয়েকজন রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। কয়েকজনের দেহ নিথর। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছেনা- তারা বেচেঁ আছে কিনা! জাকারিয়া তাদের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু পরিচিত কন্ঠের অধিকারী এক রমনীর আর্তচিৎকারে সে ফিরে তাকায়। প্রাণভয়ে মেয়েটি এমন ভাবে দৌঁড়াচ্ছে- কখন কোথায় তার জুতো খুলে গিয়েছে সে নিজেই জানেনা। বামপাশে আরেকটি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। তবে এটির তীব্রতা আগেরটার চেয়ে কম। জাকারিয়া এখন খেয়াল করে, মেয়েটি রক্তাক্ত পায়ে ছুটে আসছে। তার দিকেই আসছে। তার ক্ষতস্থান থেকে ঝরে পড়া রক্ত পথ ভিজিয়ে যেন কোনো নিশানা তৈরি করছে।
এখানে অবস্থান করা আর নিরাপদ নয়। যে হারে বোমাবাজি চলছে। যেকোনো মূল্যে শিলাকে নিয়ে এখান থেকে পালাতে হবে এবং তার নিরাময়ের জন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। শিলাকে সে একটি রিকশায় আরোহীর আসনে উঠায়। নিজে বসে চালকের আসনে। রিকশাওয়ালা রিকশা রেখে কোন দিকে পালিয়ে জান বাঁচিয়েছে- তার খবর কে রাখে! আপনা জান বাঁচা।
শিলার পা থেকে বোমার কয়েকটা স্প্রিন্টার বের করা হয়েছে। অতটা গুরুতর জখম হয়নি। জাকারিয়া তাকে ইডেন কলেজ গেটে নামিয়ে দিয়ে যায়।
প্রায় বছর দুয়েক পরের কথা। জাকারিয়া নীলক্ষেতে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে। কিছুক্ষণ ফুটপাতের বইয়ের দোকানে গিয়ে বই ঘাঁটাঘাঁটি করে। তারপর কাসুন্দি দিয়ে পেয়ারা বানানো খায়। আবার হকারের কাছে গিয়ে জিনিসের দরদাম করে কিন্তু ক্রয় করেনা। পেয়ারা খেয়ে মনে হয় জাকারিয়ার পেট ভরেনি। সে ঢুকেছে নীলক্ষেত তেহারী ঘরে। মাঝামাঝি অবস্থানে একটা টেবিলে গিয়ে বসে। তেহারীর অর্ডার দেয়। পরক্ষণেই কাকে যেন হাত ধরে টেনে তার পাশে বসায়।
‘আরে, দোস্ত তুই!’
‘হ্যাঁরে আমি।’
‘এখানে কি করিস!”
‘তেহারী খেতে আসলাম। সুঘ্রাণে আর বাইরে থাকতে পারলাম না।’
‘কতদিন পর তোর সাথে মোলাকাত!’
‘হ্যাঁ। অনেকদিন। তা তুই হাফ খাবি না ফুল!’
‘আমি খেয়েছি। মাত্র হাত ধুয়ে আসলাম।’
‘কিছুক্ষণ বসে গল্প করি।’
‘নারে দোস্ত। আজকে তাড়া আছে। তুই আসিস আমার বাসায়।’
‘ঠিক আছে। বিদায়।’
জাকারিয়া খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। খুব তৃপ্তি সহকারে সে খাচ্ছে। দেখে বোঝা যায়। আরো হাফ দেওয়ার জন্য সে বেয়ারাকে অর্ডার করে। একটু পরে তার টেবিলের পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়ায়। সে ভেবেছিলো বেয়ারা। কিন্তু চুড়ির রিনরিন শব্দে সে অবাক হয়।
‘এই যে জনাব, গাঁটের পয়সা খরচ করে যাকে খাওয়াতে চাইলেন। সেতো ডিনাই করলো। সেটা নাহয় আমাকেই খাওয়ালেন।’
‘বলেন, হাফ নাকি ফুল খাবেন!’
‘আপনাকে ধন্যবাদ। আমাকে খাওয়ানোর জন্য কিন্তু ওখানে আরেকজন বসে আছে।’
‘সে কে!’
রমনী মানে শিলার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বোঝা যাচ্ছে পরিচয় দিতে সে ইতস্তত করছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘আমি আসলে প্রথম দিনের ঘটনার জন্য দুঃখিত। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন। সেই সাথে দিপুকেও।’
‘আমি কিন্তু জানতাম, আপনাকে খাওয়ানোর জন্য ওখানে কে বসে আছে!’
‘তাহলে জিজ্ঞেস করলেন যে!’
‘আপনার মুখ থেকে শোনার জন্য।’
‘আচ্ছা, সমস্যা নেই। তা আপনি এখানে কি করছেন! মানে নীলক্ষেতে কেন এসেছেন!’
‘ আমি এখানে অফিস করছি।’
‘কোথায় আপনার অফিস!’
‘আপনাকে বুঝিয়ে বলি- এই যে আমি এখানে বসে তেহারী খাচ্ছি, আমি কিন্তু অন ডিউটি।’
‘তাই নাকি!’
‘আচ্ছা শিলা, দিপু কি আপনার বয়ফ্রেন্ড! কিছু মনে করবেন না।’
‘না।’
‘ব্যবসায়িক পার্টনার!’
‘না।’
‘তাহলে কে!’
‘আমার পূর্ব পরিচিত।’
‘পরিচয়ের সূত্রটা কি!’
‘অতকিছু আমি বলতে পারবোনা।’
‘দিপু কিন্তু আমার এক পরিচিতকে ইয়াবার সাপ্লাই দেয়।’
‘কি জানি! এ ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা।’
‘শিলা, একটা ব্যাপার কি জানেন! বলাকা সিনেমা হলের সামনে দিপুর সেই অতি উৎসাহী আচরণ আমি ভুলে গিয়েছিলাম। অথবা এ নিয়ে আমার মধ্যে কোনো ক্ষোভ ছিলোনা। অথবা আমি বিশ্লেষণও করিনি- সেদিন ইভটিজিং এর সাথে আবার ইয়াবার নাম আসলো কেন! যাইহোক, পৃথিবীটা আসলেই গোলাকার। কোনো না কোনোভাবে দেখা হয়েই যায়। আর প্রতিশোধের ক্ষেত্র অনেকসময় আপনাতেই তৈরি হয়ে যায়। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি- কিছুক্ষণের মধ্যেই দিপুকে আমি আটক করবো।’
জাকারিয়ার তেহারী খাওয়া শেষ হয়েছে। শিলা আর মুহূর্ত অপেক্ষা করেনি। ঝড়ের বেগে প্রস্থান করে। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে ফিরে আসার সময় সে একপলক দিপুর দিকে তাকায়। দিপুর চোখে জিজ্ঞাসা - হুট করে শিলা মেয়েটি তাকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেলো!
মন্তব্য করুন