আ’মরি বাংলা ভাষা!

দিলরুবা শরমিন
| আপডেট : ২০ মে ২০১৭, ১৪:১৩ | প্রকাশিত : ২০ মে ২০১৭, ১৪:০৪

বাংলা ভাষাভাষীদের লজ্জিত হওয়া উচিত। ক্ষমা চাওয়া উচিত ভাষা শহীদদের বা ভাষা বিপ্লবীদের কাছে। বাংলা ভাষার যে অশোভন ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে এটা পাগলেও বোঝে। পাগলতো তার আপন গতিতে ভাষার ব্যবহার করে, আর যারা নিজেদেরকে পাগল নন বলে দাবি করেন তারা? তারা পাগলের চেয়ে অধম।

শুরু হোক সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালতে রাষ্ট্রের প্রধান আইনজীবী ও প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ প্রবীণ আইনজীবী ডঃ কামাল হোসেনের ভাষা ব্যবহার দিয়ে। যে ভাষায় তারা মাননীয় প্রধান বিচারপতির সামনে একে অপরকে আক্রমন চালিয়েছেন সেটা সভ্য দেশের, সুনাগরিকের ভাষা হতে পারে না। প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ আইনিজীবীর তো নয়ই। তার ওপরে তারা দুইজনই ‘সিনিয়র আইনজীবী’। দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত।

একজন বঙ্গবন্ধুর সময়ের মন্ত্রী ও সংবিধান প্রণেতা বলে খ্যাত। অন্যজন বাম রাজনীতির সুশিক্ষা পেয়ে পরে সুপ্রিম কোরট বার এর নেতা মানে আইনজীবীদের নেতা এবং আওয়ামী সরকারের বিশ্বাস ও প্রিয়ভাজনেষু। এক/এগারোর পর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসাবে এই বিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গে মাননীয় প্রধান বিচারপতির প্রায়ই বাহাস হয়। প্রধান বা অপ্রধান বলে কথা নয়, যেকোন বিচারপতি বা বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীর বাহাস বিচার বিভাগের সৌন্দর্য্য নষ্ট করে।

আমার গুরু প্রয়াত এ.কে.এম সলিমুল্লাহ স্যার যার কাছে আমি আদালত পাড়ার সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনেছি, শিখেছি। তিনি আমাকে প্রথমেই যে শিক্ষাটি দিয়েছিলেন সেটি হলো, আইনজীবীর কাজ যুক্তি দিয়ে বিজ্ঞ আদালতকে বোঝানো, আইন তুলে ধরা, রেফারেন্স দেখানো, ঝগড়া কিংবা তর্ক করা নয়।

প্রবীণ, জ্ঞানী, বিজ্ঞ এই রকম অসংখ্য অলংকারে ভূষিতজনেরা যখন সভ্য সমাজে অচল ‘চল’ এর ভাষা ব্যবহারে অতি পারঙ্গম হন আমরা যাই কোথায়???

এই শ্রেনীর বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীদের শুধু মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছেই নয় ক্ষমা চাওয়া উচিত দেশ-জাতি-ভাষাশহীদ-ভাষা সৈনিক এবং আইনজীবী সম্প্রদায়ের কাছে।

ছি! শুধুমাত্র এই শব্দটিই তাদের উদ্দেশ্যে আমার বলতে ইচ্ছে করছে।

এর আগে আমরা রাজনীতিবিদদের ভাষাজ্ঞান ও সংসদ সদস্যদের আচরণবিধি নিয়ে অনেক লিখেছি। মাননীয় সংসদ সদস্যদেরকে সুশীল ভাষায় প্রশিক্ষিত করতে নানা উদ্যোগ ও আমরা নিতে দেখেছি তারপরও বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে দু-চারজন মহিলা সংসদ সদস্যদের অশ্রাব্য ভাষণ আমরা শুনেছি। তাদেরকে আদর্শ ভেবে আওয়ামী লীগের দু-চারজনও সেসব ভাষা রপ্ত করেছিলেন বেশ ভালোভাবেই।

দেশের কোন কোন টেলিভিশন চ্যানেল আবার এই সব নেত্রীদের কথা শুনতে পছন্দ করেন। বিধায় সঞ্চালককে দিয়ে একটা চাবি মেরে ছেড়ে দেন আর মুচকি মুচকি হাসেন। আর মাননীয় নির্বাচিত বা অনির্বাচিত এইসব কুলটা নারী একদমেই সাফা করে দেন যা তাদের গহবরে আছে। ভাবেন আরেকজনকে যত অশ্লীল বাক্যবাণে আঘাত হানা যাবে দেশনেত্রী বা জননেত্রীর কাছে ততটাই গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। আসলে ঘটেও তাই।

নোংরা ভাষা ব্যবহারের অশুভ প্রতিযোগিতা রাজনীতিবিদেরা আসলে কখন করেন? যখন দেশ-জাতি-রাজনীতি-অরথনীতি নিয়ে ন্যূনতম জ্ঞ্যান থাকে না তখনই কেবল এসব অশ্রাব্য শব্দসম্ভার তাদের রক্ষাকবচ। তাদের আমরা ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখার চেষ্টা করি, কারণ আমরা জানি সকলেই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মহান জাতীয় সংসদ অলংকৃত করতে আসেন নাই। এই মহান ভবনে তাদের অনেকেরই অনুপ্রবেশ নানা ছলে–বলে-কৌশলে। তাদের অনেকেরই ব্যাকগ্রাউন্ড ততটা ‘সমৃদ্ধ’ নয়, যতোটা বিলাসব্যসন তারা ভোগ করছেন।

চকচক করলেই তো আর সোনা হয় না। সকল হীরাই কাচকাটা হীরা নয়।

এই নিম্নশ্রেনীর ভাষা ব্যবহার নিয়ে অনেক কথা বারংবার মহান জাতীয় সংসদে, আদালতে বলা হয়েছে। নিষেধ করা হয়েছে। কখোনো এচপাঞ্জ করাও হয়েছে। তারপরও কেউই থামেনি। আমরা আসলে থামি না, আমাদের থামাতে হয়।

দেশের গুরুত্বহীন ব্যক্তি থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সকলেই কথা বলতে ব্যস্ত। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মসজিদ মন্দির, স্কুল কলেজ কোথায় চুপ করে আছে কেউ? কথা বলেই যাচ্ছে! কথা বলার প্রতিযোগিতা যুদ্ধ চলছে। টেলিভিশন বেতার যাই কোথায়? তাও যদি হতো সুস্থ কথা, সুন্দর কথা। সবই যেন গুলিস্তান বা সদরঘাট। অথচ কাজের কথা বলতে বলুন বেলুনের মত চুপসে যাবে।

আগে একটা বিশেষ পেশার প্রধানকে কথা বলতেই শুনতাম না। তার চেহারা ছিল সকলের কাছে অস্পষ্ট। নীরবে নিভৃতে, সব কিছু উর্ধ্বে থেকে তিনি কাজ করে যেতেন। আজ? সেই একই পেশার মানুষ নিজেতো বক্তব্য রাখেনই পাশাপাশি রীতিমত ঝগড়াবিবাদ হানাহানিতে লিপ্ত হবার উপক্রম। তাকে কে থামাবে?

সম্প্রতি অসভ্য কথা বলার সুদীর্ঘ লাইনে সংযুক্ত হয়েছেন সুবক্তা বলে পরিচিত আনিসুল হক (বরতমান মেয়র ঢাকাউত্তর সিটি)। ক্ষমতা, সাহস ও শক্তি বলে তিনি তেজগাঁওয়ে অবস্থিত অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদের সময় শালীন-অশালীন অনেক কথা বলেই আমাদের বাহবা কুড়িয়েছেন। কিন্তু আসলে এই সস্তা বাহবার আড়ালে তিনি নিজে কি অর্জন করেছেন ???

সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অডিটোরিয়ামে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ আয়োজিত কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন । সেখানেও তিনি জি–৪ সিকিউরিটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘সেদিন দেখি জি-৪ নামে একটি সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান আমাদের রাস্তার উপর তাদের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। লিখে দিয়েছে ‘নো পার্কিং’। এটা কি তাদের বাবার রাস্তা?”

একজন মেয়র, যাকে আমরা বলি নগরপিতা তিনি এই ধরনের শব্দ আসলেই ব্যবহার করতে পারেন কি? একজন নগরপিতা যদি এই শব্দ ব্যবহার করেন তবে সেই নগরের সন্তানরা কি ভাষা ব্যবহার করবেন ???

ভাষা শালীন হওয়া যে কত জরুরী সেটা কি আমরা বুঝি না, জানি না? কেবল কথার উপর কোন ট্যাক্স নাই বলেই আমরা যা ইচ্ছা তাই বলে যাবো? অরথমন্ত্রী তো সুযোগ পেলেই ট্যাক্স আর ভ্যাট বসান তো এত বড় একটা আয়ের উৎস তার অজানাই থেকে যাচ্ছে???

সভ্যভাষা বা আচরণের যেকোন বিকল্প নেই বা সভ্যতার যেকোন বিকল্প নেই এটা আমরা কি কেউ বুঝি না? কেউ না? রাষ্ট্রের প্রধান থেকে শুরু করে তার জনগনের সর্বনিম্ন পর্যায়ে কেউ না? আমরা বাচ্চাদের কি শেখাবো? আমাদের আগামী প্রজন্মকে নিয়ে কি আমরা কিছুই ভাবি না?

আপন জুয়েলার্সের মালিকের অশোভন ও অশালীন কথায় কি আমরা খুব বেশি বিস্মিত বা আহত হয়েছি? হইনি। কারণ এসব আমরা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। ঢাকাই চলচিত্রে ডিপজলের মত ভিলেনের আগমন বা জনপ্রিয় ভিলেন হওয়া কি খুবই বিস্ময়কর???

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :