প্রধান ভাই ছাত্রলীগে একজন অনুপ্রবেশকারী ছিলেন?

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
 | প্রকাশিত : ২১ মে ২০১৭, ১৫:৫৯

সকালে পত্রিকা খুলতেই দেখি জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) নেতা শফিউল আলম প্রধান অর্থাৎ আমাদের একসময়ের অতি প্রিয় প্রধান ভাইয়ের ইন্তেকালের (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না লিল্লাহে রাজেউন) সংবাদl এই বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন তা কখনো চিন্তাও করিনিl স্বাধীনতার পর পর ছাত্র রাজনীতিতে একসময়ের সাথী ও আমাদের মতো তরুণদের অত্যন্ত প্রিয় নেতা প্রধান ভাইয়ের এই আকস্মিক অন্তর্ধান অত্যন্ত দুঃখজনকl বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে তিনি আমাদের বিপরীত মেরুকরণে অবস্থান করলেও তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সবসময়ই ছিলl

১৯৭৩-৭৪ সাল। এইসময় ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দুইটি কমিটির প্রস্তাব কর্মীদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পরে। একটি মনির-প্রধান (মনিরুল হক চৌধুরী-শফিউল আলম প্রধান) ও অন্যটি রশিদ-হাসান পরিষদ (এম এ রশিদ-রাশিদুল হাসান)। আমি তখন ঢাকা মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আমাদের মনোনীত পরিষদ ছিল মনির-প্রধান পরিষদ। শেখ শহিদুল ইসলাম ও এম এ রশিদ ছিলেন তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র কামাল ভাইয়ের(শেখ কামাল) সমর্থন ছিল মনির-প্রধান পরিষদের পক্ষে। যার কারণে আমরা ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের এক বিরাট অংশ মনির প্রধান-পরিষদের পক্ষে স্লোগান দিয়েছিলাম। শুধু তাই নয় রাজ্জাক ভাই ও তোফায়েল ভাইও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন মনির-প্রধান পরিষদের পক্ষে।

সন্মেলনের দিন ঘনিয়ে এলে বিভিন্ন জেলা ছাত্রলীগ থেকে নেতা কর্মীরা যখন ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছতেন, আমরা তখন তাদের মনির-প্রধান পরিষদের পক্ষে স্লোগান দিয়ে স্বাগতম জানিয়েছিলাম। অন্যদিকে যুবলীগের সভাপতি মনি ভাইয়ের (শেখ ফজলুল হক মনি) সমর্থন ছিল রশিদ-হাসান পরিষদের পক্ষে। তিনি সবসময় বলেছেন শফিউল আলম প্রধানের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়া এই মুহূর্তে ঠিক হবে না। তাকে আরও অপেক্ষা করতে হবে।

শফিউল আলম প্রধানকে মনি ভাই এতটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিছু কিছু কারণে সন্দেহ করতেন। কিন্তু আমরা ওই সময় প্রধান ভাইয়ের খুব ভক্ত ছিলাম। কামাল ভাইয়ের নির্দেশে অন্ধের মত সমর্থন জানিয়েছিলাম প্রধান ভাইকে।

নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারর্স ইনস্টিটিটিউশন মিলনায়তনে সন্মেলন শুরু হয়। শহীদ ভাই মঞ্চে দাড়িয়ে একে একে কমিটির নাম ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শফিউল আলম প্রধানের নাম ঘোষণা করতেই তিনি মঞ্চে উঠে প্রথমেই শেখ শহিদুল ইসলাম ভাইয়ের পা স্পর্শ করে সালাম করেন। এই সময় ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটের বাহিরে কামাল ভাই আওরঙ্গসহ আরও কিছু ছাত্রলীগের কর্মী সবকিছু তদারকি করেন। এভাবেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন শফিউল আলম প্রধান।

ওই সময় তার জ্বালাময়ী ভাষণ আমার মতো অনেক তরুণদের উৎসাহিত করতো বৈকি। অত্যন্ত ভালো ভাষণ দিতেন প্রধান ভাই।

একদিন আমরা ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যাই। ইতিমধ্যে আমি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হই। কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে সেদিন আমিও গণভবনে গিয়েছিলাম।

রমনা পার্কের এই গণভবনে প্রবেশ করে আমরা সকলেই ঘাসে বসে বঙ্গবন্ধুর উপদেশ শুনছিলাম। বঙ্গবন্ধু বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে আমাদের সাথে কথা বলছিলেন। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল ভাই। একসময় বঙ্গবন্ধু তোফায়েল ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোফায়েল দুইটা ফুল দেও’। তোফায়েল ভাই বারান্দার পাশ ঘেষে ফুটে উঠা গোলাপ গাছ থেকে দুটো ফুল এনে বঙ্গবন্ধুর হাতে দিলেন। বঙ্গবন্ধু টকটকে লাল গোলাপটি দিলেন শফিউল আলম প্রধান ভাইয়ের হাতে আর গোলাপী রঙের ফুলটি দিলেন মনি ভাইয়ের হাতে।

বঙ্গবন্ধু এখানেই আমাদের হয়তো ইশারায় ইঙ্গিত দিলেন শফিউল আলম প্রধানের অতিবিপ্লবী বক্তব্য সম্পর্কে। একে অনেকটা পরোক্ষভাবে সতর্ক থাকার নির্দেশ বলা যেতে পারে। এনিয়ে আমাদের মধ্যে প্রধান ভাইয়ের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে কথা হয়েছে অনেক। কিন্তু কেন জানি না তবুও কখনো তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেনি আমরা।

কামাল ভাই প্রধান ভাইকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন। ফলে আমরা যারা কামাল ভাইয়ের কাছাকাছি ছিলাম তারা প্রধান ভাইয়ের প্রতি সব সময় অন্ধের মত দৃঢ় সমর্থন দিয়েছিলাম। তাকে কখনো সন্দেহের চোখে দেখিনি। পরবর্তীতে একসময় রমনার বটমূলে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে তিনি আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা ‘দুর্নীতিবাজ’দের একটা তালিকা প্রকাশ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে তাদের বিচার দাবি করেনl

ছাত্রলীগ তখন সরকার দলীয় সমর্থিত ছাত্র সংগঠন হলেও তার রাজনৈতিক ভূমিকা অনেকটা সরকারের বিপক্ষে এসে দাঁড়ায়l আমরা তখন প্রধান ভাই বলতে অন্ধl নাম তালিকা ঘোষণার সময় স্লোগানে স্লোগানে পুরো রমনাকে কাঁপিয়ে তুলেছিলাম। এই সময় মঞ্চে অতিথি হিসেবে বসেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানসহ আরো অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। প্রধান ভাইয়ের জ্বালাময়ী ভাষণ ও নেতৃত্ব এইসময় তাকে ছাত্রলীগে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলে। অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে তার বিপক্ষ শক্তি তাকে আঘাত করার অপেক্ষায় একত্রিত হতে থাকেl

এর মধ্যে একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে ঘটে যায় সাতজন ছাত্র হত্যার ঘটনাl যেদিন রাতে এই ঘটনা ঘটে সেদিন ছাত্রলীগ অফিসে প্রধান ভাইয়ের সাথে আমাদের একটা মিটিং হয়। ছাত্রলীগ অফিসের টেলিভিশন চুরি হওয়ার ব্যাপার নিয়ে আলোচিত এই সভা গভীর রাত পর্যন্ত হয়। মিটিং শেষে নীলক্ষেতের একটি রেস্টুরেন্টে বসে আমরা কয়েকজন রাতের খাবার খাওয়ার পর প্রধান ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে হেঁটে চলে যান।

আমি ও ঢাকা মহানগর ছাত্র লীগের সভাপতি সৈয়াদ নুরুল ইসলাম ভাই ঢাকা কলেজের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে ফিরে আসি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘটনার কথা জানতে পারি। তবে প্রধান ভাইয়ের জড়িত থাকার ব্যাপারে তখন কোনো কিছুই জানা ছিল না।

কিছুদিন পর একদিন সন্ধ্যায় মিরপুর রোডের ছাত্রলীগ অফিসের পাশে সীতারাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে আমরা চা পান করছিলাম। প্রধান ভাইও সেখানে ছিলেন। হটাত কয়জন সিভিল পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এর পর থেকেই আমরা এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানাতে থাকি। ওই সময় আমাদের স্লোগান ছিল, ‘মিথ্যা মামলা ষড়যন্ত্র মামলা মানি না, মানি না’; ‘প্রধান ভাইকে ছাড়তে হবে, নইলে বাংলায় আগুন জ্বলবে।’

পরবর্তীতে সাক্ষী প্রমাণসহ বিচারে প্রধান ভাইয়ের যাবজ্জীব কারাদণ্ড হয়। ঘটনায় জড়িত রফিকসহ আরো কয়জন রাজসাক্ষী হয়ে ঘটনার সবকিছু আদালতে ফাঁস করে দেন।

ঢাকা জজ কোর্টে মামলা চলাকালীন সময়ে ঢাকার তৎকালীন সিটি এস পি মাহবুব ভাইয়ের কাছ থেকে দুইটি পাশ নিয়ে আমি ও নুরু ভাই একদিন তার সাথে দেখা করতে আদালতে গিয়েছিলাম। ভেতরে ঢুকতেই দেখি প্রধান ভাই কোর্টের ভেতরে একটি লোহার বন্ধনীর মধ্যে দাড়িয়ে আছেন এবং একসময়ের মুসলিম লীগ নেতা ও পূর্ব পাকিস্থানের সাবেক স্পিকার গমির উদ্দিন প্রধান তার পক্ষে আদালতে জেরা করছেন। তিনি হলেন প্রধান ভাইয়ের বাবা।

এই সময় বিরতি হলে প্রধান ভাইয়ের ছোট বোন ও ভাবির (বড় ভাইয়ের স্ত্রী) নিয়ে আসা খাবার প্রধান ভাইকে দিলে তিনি খেতে খেতে একটু খাবার লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে আমাদের খেতে দিলে আমরা আপত্তি করি। তখন প্রধান ভাইকে এই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব সন্মোধন করতে দেখলাম। বললেন, ‘এতে কোনো বিষ মিশিয়ে দেইনি। তোরা তো শেখ মুজিবের সৈনিক। তোদের কি কেউ মারতে পারে?’।

কেন জানি না আমার তখন শেখ ফজলুল হক মনি ভাইয়ের কথা মনে পরে গেল। তাহলে কি সত্যি সত্যি প্রধান ভাই ছাত্রলীগে একজন অনুপ্রবেশকারী ছিলেন?

ঐতিহাসিক সেভেন মার্ডারের জন্য শফিউল আলম প্রধানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় বসে ঠিক যুদ্ধাপরাধীদের মতই তাকেও মুক্ত করে দিলেন। মুক্তি পেয়ে পরবর্তীতে একসময় প্রতিষ্ঠা করেন ওয়ানমেন পার্টি ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, যা শুধু নামেই আছে কাজে নেই।

এই দলের ব্যানার নিয়ে বিএনপির জোটে দাঁড়িয়ে যেসব বক্তব্য তিনি রাখতেন তার সাথে হুবহু মিল রয়েছে পিতার রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের সাথে। গমির উদ্দিন প্রধান জীবিত থাকলে সন্তানের জন্য হয়তো খুব গর্ব করতেন। কারণ তার দল মুসলিম লীগ আজ না থাকলেও দলের আদর্শের কথা বলছে তারই সন্তান।

মহসিন হলে ছাত্র হত্যা ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শফিউল আলম প্রধান বলেন, দুর্নীতিবাজদের নাম তালিকা প্রকাশের কারণেই তার উপর নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি আজ এদেরই চক্রান্তের শিকার।

দুর্নীতিবাজদের তালিকা ঘোষণার কথাটা অবশ্যই সত্য। কারণ আমি সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম। তাহলে কি আজও সঠিকভাবে প্রকাশ হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের সেভেন মার্ডারের আসল সত্য? তবে একথা মানতে অনেকেই রাজি নন। যেখানে আসামি রাজসাক্ষী হয়ে ঘটনার সবকিছু ফাঁস করে দিয়েছে সেখানে এ ব্যাপারে দ্বিমত আসার কোনো প্রশ্ন আসতে পারে না।

শফিউল আলম প্রধান ছিলেন ছাত্র হত্যার মূল ব্রেইন। শুধু তাই নয়, হত্যার সময় তিনি সেখানে স্বশরীরে উপস্থিতও ছিলেন বলে প্রকাশ করেছে রাজসাক্ষীরা। শফিউল আলম প্রধান যে আসলেই ছাত্রলীগে একজন অনুপ্রবেশকারী ছিলেন তা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তার বিভিন্ন কার্যকলাপ প্রমাণিত করে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা দুই মেরুকরণে অবস্থান করলেও তার প্রতি আমার সবসময় থাকবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি একসময় ছিলেন ছাত্রলীগ রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। স্বাধীনতা পরবর্তীতে ছাত্রলীগের মধ্যে তিনি এনেছিলেন প্রাণ চাঞ্চল্যতা। প্রধান ভাইয়ের এই আকস্মিক মৃত্যুতে আমি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং তার স্ত্রী আমাদের রেহানা আপা সহ শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: সুইডেনে মূলধারার রাজনীতিতে জড়িত

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :