এত মার্কিন অস্ত্র দিয়ে কী করবে সৌদি আরব?

আমিনুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ২২ মে ২০১৭, ১৮:০৮

সময়টা ১৯৬৩ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী ও সুদর্শন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর সদ্য নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন ১০ মাস দেরি করেছিলেন বিদেশ সফর করতে। প্রেসিডেন্ট নিহত হওয়ায় তখন ছিল একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। তাই, এত দেরি হয়েছিলো।

কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে প্রায় ১১৯ দিন পার করে দিলেন মার্কিন মুল্লুকে বসেই। ঘরকুনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি পাওয়া ট্রাম্প অবশেষে বের হলেন নয় দিনের প্রথম বিদেশ সফরে। ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের বন্ধু রজার স্টোন জানান, ‘ট্রাম্প এমন এক ব্যক্তি যিনি নিজের সোফায় বসে ভালো একটা চিজ বার্গার খেতে ভালোবাসেন। তিনি নিজের বিছানায় ঘুমাতে পছন্দ করেন।’

সেই ঘরকুনো ট্রাম্প অবশেষে বিদেশ সফরে বের হলেন। প্রথমেই বেছে নিলেন সৌদি আরবকে। তার পর যাবেন ইসরাইল, ফিলিস্তিন, বেলজিয়াম, ভ্যাটিক্যান ও সিসিলিতে। গোটা বিশ্বের কূটনীতিবিশারদরা হতবাক। যে ট্রাম্প পারলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিতে চান, তিনিই আবার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বেছে নিলেন ইসলামের জন্মভূমি সৌদি আরবকে?

ট্রাম্পের সৌদি সফর পশ্চিমা বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে একেবারেই আশ্চর্যজনক একারণে যে, ট্রাম্পের পূর্বসূরী চার জন প্রেসিডেন্ট তাদের প্রথম সফর করেছেন মেক্সিকো অথবা কানাডাতে। দেশ দুটি আমেরিকার প্রতিবেশী এবং উন্নত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। পক্ষান্তরে, সৌদিতে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই এবং যে দেশে নারীদেরকে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কোথাও বেড়ানোর সুযোগটুকু পর্যন্ত নাই। সৌদি আরবের মাটিতে দাঁড়িয়ে ইসলামী চরমপন্থার বিরুদ্ধে কথা বলা কিছুটা হলেও স্ববিরোধিতা। যদিও সৌদি আরব ইসলামী চরমপন্থা নিয়ে ভীত, কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, কট্টর ওহাবী মতবাদ সৌদি আরবের প্রশ্রয়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে এবং এখনও তা ছড়াচ্ছে। নাইন-ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে হামলা চালানো মোট ১৯ জন নাগরিকের মধ্যে ১৫ জনই সৌদি।

ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার কলামিস্ট এ্যান অ্যাপ্লেবাম প্রশ্ন তুলেছেন, সৌদি আরবের নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক ও তার হোমড়া-চোমড়াদের সঙ্গে ট্রাম্প যেভাবে ‘তলোয়ার নাচ’ নাচলেন, তা আমেরিকার উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পূর্ববর্তী কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্টই সৌদি আরবে গিয়ে এসব করেননি। শুধু তাই নয়, ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প সৌদি নারী উদ্যোক্তাদের সাথে মাখামাখি করলেন, একবারও উচিত ছিলো না সৌদি আরবের নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে কিছু বলা? তা তিনি করবেন কেন?

তিনি গিয়েছিলেন তার ফান্ডের টাকা তোলার জন্য। সে কাজে তিনি শতভাগ সফল। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত তার ফান্ডে বিপুল পরিমাণ টাকা দিতে রাজি হয়েছে।

মানবাধিকার নিয়ে বড় গলায় কথা বলা আমেরিকার বহু পুরনো অভ্যাস। তাই বলে সৌদি আরবের মাটিতে দাঁড়িয়ে ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার চেয়ে হাস্যকর আর কিছু হয় না। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যাই হোক না কেন, ইরান সৌদি আরব থেকে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। সৌদি আরবে বিন্দুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা নাই, কোনো ধর্মীয় স্বাধীনতা নাই-এরকম দেশে বসে আরেক দেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলা ভ-ামি ছাড়া আর কিছুই না।

যাই হোক, ট্রাম্পের সৌদি সফরের মূল কারণ যে আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ-তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও লোক দেখানো আরব-ইসলামিক-অ্যামেরিকান সামিট আয়োজন করেছেন সৌদি বাদশাহ, আসল কারণ হচ্ছে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে দেখিয়ে দেয়া যে-‘দেখো, আমেরিকা আমাদের কত আপন! আমাদেরকে সমঝে না চললে ইরান তোমার খবর আছে’।

সৌদি রাজার সাথে ৩৫ হাজার কোটি ডলারের চুক্তি করেছেন ট্রাম্প। তার মধ্যে অস্ত্র বিক্রির অঙ্কটাই ১১ হাজার কোটি ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় হয় প্রায় নয় লাখ কোটি টাকা। দুই দেশের মধ্যে এত বড় অস্ত্র চুক্তি আর হয়নি। অস্ত্র বিক্রি করে মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা রাখা আমেরিকানদের বহু পুরনো সংস্কৃতি। এই চুক্তির বলে সৌদি আরব বিশ্বের শীর্ষ আমদানিকারক দেশে তো পরিণত হবেই। বিনিময়ে আমেরিকা তাকে দিবে মিসাইল, বোমা, সুসজ্জিত সামরিক যান, যুদ্ধজাহাজ, থাড ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-এত অস্ত্রশস্ত্রের দরকার পড়লো কেন সৌদি আরবের?

চুক্তি সইয়ের সময়েই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলে দিয়েছেন- ইরানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্যই সৌদি আরবের এত অস্ত্র প্রয়োজন। বাহ! কী চমৎকার যুক্তি। আমাদের বঙ্গীয় মুসলিমরা মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব কামনায় কত মশগুল, অথচ মুসলিম উম্মাহর লিডার সৌদি আরব প্রতিবেশী আরেকটি মুসলিম দেশকে ঘায়েল করার জন্য আমেরিকা আর ইসরাইলের সাথে মিলে কী পরিমাণ সহী নিয়ত অন্তরে পোষণ করে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ইরানের তরুণ সমাজ যখন উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানীর পুনর্নির্বাচিত হওয়ার বিজয় উদযাপন করছে, তখন সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের অন্তত ৪০ টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের ডেকে এনে ইরানের বিরুদ্ধে নিরন্তর কুৎসা রটাচ্ছে। এসব অস্ত্র চুক্তি না করে একটিবার কি ইরানের সাথে শান্তি আলোচনা করার উদ্যোগ নেয়া যেত না? পূর্বসূরী বারাক ওবামার নীতিকে পদদলিত করে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি ও তার মিত্রদের হাতে অস্ত্রের ভাণ্ডার তুলে দিচ্ছেন। এতে করে চাঙ্গা হচ্ছে-তার দেশের অস্ত্রভিত্তিক অর্থনীতি। আর মধ্যপ্রাচ্যে বাড়ছে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা।

মুসলমানরা পারেও বটে, যদি কোনোদিন ইরানের সাথে সৌদির সংঘাত সৃষ্টির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখন তারা আবার বলবে-এগুলো সব আমেরিকার ষড়যন্ত্র। মুসলিমদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধাতে চায়। কিন্তুু মুসলমানরা যে নিজেই নিজের ক্ষতি করতে উস্তাদ সেটা মুসলমানরা স্বীকার করে না, এটাই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা তাদের।

লেখক: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :