জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: সমাবর্তন এবং প্রশাসনের উদাসীনতা

সাকিব আল মামুন
| আপডেট : ২৩ মে ২০১৭, ১২:১০ | প্রকাশিত : ২৩ মে ২০১৭, ১২:০৫

উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ পাদপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে সমাবর্তনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার স্বীকৃত গ্রহণ করা। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আনন্দঘন মুহূর্ত নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেয়া হয়। সমাবর্তন বা আনুষ্ঠানিক সার্টিফিকেট গ্রহণের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থী এ দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে। হাসি-কান্না, আনন্দ -বেদনা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের হাজারো স্মৃতির সম্মিলন আর অর্জিত বিদ্যার স্বীকৃতি; সবকিছুই যেন ভেসে উঠে সমাবর্তনের কালো গাউন আর আকাশ পানে চারকোণা কালো টুপির উর্ধ্বমুখী ছোড়াছুঁড়িতে।

বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সারির প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিদায় জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকবার এই আনন্দঘন মুহূর্ত উপভোগ করেছে শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৫০ তম সমাবর্তনের আয়োজন করে তাদের শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষাজীবনের সনদ তুলে দিয়েছে।

রাজধানী ঢাকার মূল অংশে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীন শিক্ষালয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। হাজারো স্মৃতির সম্মিলনে কালের সাক্ষী এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ স্কুল থেকে শত সহস্র বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ১৪৭ বছর পরে বাংলাদেশ সরকার মহান জাতীয় সংসদে 'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫' পাশের মাধ্যমে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মোচন করে। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে; কিছুক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রোল মডেল হয়ে আছে। নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় হয়েও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে দ্বিতীয় পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথম বারকোড পদ্ধতিতে পরীক্ষা চালু করে। ইতোমধ্যে; বিসিএস সহ সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন চাকুরীতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টি করেছে।

প্রতিষ্ঠার একযুগেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সমাবর্তনের আশা করতে পারেনি শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির সমাবর্তন প্রত্যাশী গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ৫৮ হাজারেরও বেশি । এ বিশাল সংখ্যক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদেরকে সমাবর্তন বা কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সনদ প্রদান করছে ফলে এ নিয়ে প্রাক্তন এবং বর্তমান শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে।সমাবর্তনের দাবীতে শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে উপাচার্যের কাছে বহুবার দাবী তুলেছে ; কিন্তু উপাচার্য সহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কোন আশানুরূপ জবাব পায়নি। কর্তৃপক্ষ বারবার জায়গা সংকুলানের কথা বলেন যা একটি অযৌক্তিক এবং বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য ছাড়া কিছুই নয়।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নোটিশে শিক্ষার্থীরা মূল সনদ নিতে পারবেন বলে জানানো হয়। কর্তৃপক্ষের এ ধরনের ঘোষণায় তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও একাধিক সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে রাজধানীতে অবস্থিত হয়েও জবিতে সমাবর্তন হচ্ছে না। এ জন্য প্রশাসনের সদিচ্ছাকে দায়ী করা অস্বাভাবিক নয়।

২০০৫ সালে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয় এবং একই বছর থেকে ক্যাম্পাসে অধ্যয়নরত কলেজ আমলের (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি হওয়া) ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের ৪ হাজার ৬৬ জন এবং ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষের ১৫ হাজার ৭১০ জন ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সনদ পাবেন অর্থাৎ কলেজ আমলের ১৯ হাজার ২৭১ জন ছাত্র-ছাত্রী এই সনদ পাবেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেন।

২০১২ সালের ১৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে বলা হয়, কলেজ আমলের দুটি ব্যাচসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২২ হাজার ৬৬৫ জন শিক্ষার্থী মাস্টার্স শেষ করেছেন। এরপর আরও ৬টি শিক্ষাবর্ষ শেষ হয়েছে। এ হিসেবে বর্তমানে সমাবর্তন প্রত্যাশী গ্র্যাজুয়েট সংখ্যা ৫৮হাজার ছাড়িয়েছে। সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের মাধ্যমে সনদ বিতরণের ধারা প্রচলিত থাকলেও এদিকে মনোযোগী নয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।সমাবর্তন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গড়িমসির কারণে প্রাক্তন এবং বর্তমান শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ বৈ আর কী করতে পারে?

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত বলে এর আয়তন অনেক কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসের আয়তন খুব ছোট এটা সত্যি কিন্তু ধুপখোলায় অবস্থিত এর কেন্দ্রীয় খেলার মাঠটি কোন অংশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের চেয়ে ছোট হবে না। কমপক্ষে ১লাখ ২০ বিশ হাজার থেকে দেড় লাখ শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন আয়োজনের জন্য এ মাঠের ধারণক্ষমতা নিশ্চিত করে বলা যায়। সমাবর্তনের প্রধান অতিথি মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার জন্য দুই হাজার নিরাপত্তারক্ষীর বলয় সৃষ্টি করা অসম্ভব হবেনা। গত ১৯ শে মে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) মাদক ও সন্ত্রাস বিরোধী অনুষ্ঠান করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, এই কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে সমাবর্তন করা সম্ভব। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাসে( সাড়ে তিন একরের) সমাবর্তনের কথা বলে শিক্ষার্থীদের সাথে চরম হাস্যকর তামাশা সৃষ্টি করছে। প্রশাসনকে বলছি, আপনারা একবার কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আসেন দেখে যান, সমাবর্তন করা সম্ভব এই মাঠে।

বঙ্গভবন থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আগমনে সময় লাগবে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে সাত মিনিট। এ পাঁচ মিনিটের দূরত্ব কী নিরাপত্তার জন্য কিংবা সমাবর্তনের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে? সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো জগন্নাথের প্রশাসন কে সহযোগিতা করবে, আশা করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে আগামী তিনমাসের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রথম সমাবর্তনের আয়োজন করতে পারে। জগন্নাথের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলন মেলা, সমাবর্তনের আক্ষেপ, প্রশাসনের উদাসীনতা সহ সকল বাধাবিপত্তি দূর হোক, এ অধম বান্দার এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :