বৈষম্য, নারী ও সাংবাদিকতা

নাসরিন সুমি
 | প্রকাশিত : ২৩ মে ২০১৭, ২০:৫০

পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন দেশের নারীরা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল তার সঠিক তথ্য উপাত্ত দেয়া একটু কঠিন হলেও একথা সবার জানা আছে যে বাংলাদেশে ১৯৬০ সাল থেকে নারীরা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করা শুরু করেন। প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ এর সম্পাদনা শুরু করেন বেগম সুফিয়া কামাল। পরে নুরজাহান বেগম এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। অবশ্য সে সময় নারীরা সাংবাদিকতায় আসতেন কেবলমাত্র আগ্রহ থেকে এবং সময় কাটানোর জন্য।

কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও এ পেশাতে জড়িত হচ্ছেন অনেক নারী। দেশে এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত বাংলাদেশের অনেক নারীই মেধা ও সাহসিকতার সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট আছেন। প্রমাণ করতে চলেছেন যে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে নারী সাংবাদিকরাও একটি যুগান্তকারী অবদান রাখতে পারেন।

সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। তা আবার নারীদের জন্য। যুগ যুগ থেকে লালন করা আমাদের পুরুষ শাষিত সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী সাংবাদিকতায় এসে কতটা স্বাচ্ছন্দে কাজ করতে পারছেন, তা নিতান্তই প্রশ্নবিদ্ধ। সমাজে বিরাজমান নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলেছে নারী আবার বেড়ে চলেছে নারী বৈষম্যও। সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত নারীদের ক্ষেত্রে ও এর ব্যতিক্রম নয়।

আমরা সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রের কথা বলছি কিন্তু প্রিন্ট, অনলাইন, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াতে এখন পর্যন্ত যারা বড় বড় পদগুলো আছেন তাদের খুব কম অংশই নারী। বিভিন্ন মিডিয়ার সম্পাদনাতে নারীদের উপস্থিতি অপ্রতুল। অথচ নারীদের মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে এই ক্ষেত্রটিতে একটা মহাজাগরন তৈরি করা যেতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।

সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রোগ্রামে নারী সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। গত ১৩ জুলাই ২০১৫, ডেইলি স্টার ভবনের চার তলায় সেইভ দ্য চিলড্রেন ও এমএমসি নামক একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়োজিত ‘মিডিয়া রোল ইন চাইল্ড পার্টিসিপেশন’ শিরোনামে একটি কর্মশালায় বিভিন্ন মিডিয়া থেকে অনেক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি দেখতে পেলাম কিন্তু নারী প্রতিনিধি ছিল শূন্যের কোটায়। বিভিন্ন মিডিয়াতে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় খুব কমই দেখা যায়। গত ২৫ তারিখ বিএনএনআরসি নামক এক প্রতিষ্ঠান থেকে একটি মেইল পেলাম তাতে দেখতে পেলাম ‘কমিউনিটি রেডিও ভিডিও চ্যালেঞ্জ-২০১৫’ শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিযোগিতার বিজয়ী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া নির্ধারিত জুরি বোর্ড এর চার জন এর মধ্যে মাত্র একজন নারী।

সাংবাদিকতা পেশায় নিযুক্ত নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে রয়েছে নানা বৈষম্য। সরকার অনুমোদিত ছয় মাস এর জায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলে। বেতন ভাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে একজন নারী সাংবাদিককে প্রাপ্য অধিকার বিভাজনের সম্মুখীন হতেই হয়। কারণ তাকে মানুষ নয়, সাংবাদিক নয়, একজন নারী হিসাবেই পরিগণিত করা হয়ে থাকে। এত গেল আমাদের নগর ভিত্তিক সমাজের চিত্র।

মফস্বল শহরে সমাজে একজন নারী সাংবাদিকের প্রতিবন্ধকতা আর বৈষম্য আরও প্রকট। রেডিও বিক্রমপুর নামক একটি কমউিনিটি মিডিয়াতে কাজ করছেন সানজিত কাউসার স্বপ্নিল। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি রেডিওতে যখন কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেছি, তখন আমার মা ছিল আমার একমাত্র বৈষম্যের কারণ। আমার মায়ের মতে- পরিবারের অন্যান্যদের মতো আমি রাস্তায় বের হয়ে কাজ করব এটা সমুচীন নয়। তারপরও রেডিওতে কাজ করার সুবাদে নারী সাংবাদিকতায় ফেলো গ্রহণ করি।

ফেলোর কাজ সমাপ্ত করতে গিয়ে অন্যান্য সহকর্মীদের সহযোগিতা পেতে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে আমাকে। নারী হিসাবে জেলা-থানা পর্যায়ে প্রেসক্লাবগুলোতে দায়িত্বশীল পদগুলোতে নারী সাংবাদিকদের পদচারণা নেই বললেই চলে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীদের যোগ্য মনে করা হয় না। কেউ নিজ উদ্যোগে উঠে আসতে চাইলেও নানা প্রতিবন্ধকতা আর পুরুষতান্ত্রিক প্রভাবের কারণে পিছিয়ে থাকতে হয় নারী সাংবাদিকদের। এত গেল বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকদের অবস্থা।

বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশেই এখন পর্যন্ত নারীদের অবস্থান প্রান্তিক। যার কারণে গণমাধ্যমগুলোতে নারী সাংবাদিকরা নিজেদের যথাযথ জায়গা করে নিতে পারেনি। আফগানিস্তানের মত দেশে নারী সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন।

এতসব বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও নারী সাংবাদিকরা সমাজ বিনির্মানে কাজ করছেন।আর সে জন্য নারী সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিতের জন্য এগিয়ে আসতে হবে সকলকে তথা স্বয়ং নারীদের, সরকার ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরকে। নারী সাংবাদিকদের উদ্যোগ নিতে হবে নিজেদের অধিকার ভিত্তিক কথা বলার জন্য।

এ পেশায় নারীদের আরও উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোটা বাড়াতে হবে। নারী সাংবাদিকদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বৈষম্য বিলোপ করে একটা সমতা ও মর্যাদাভিত্তিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য চর্চা শুরু করতে হবে পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে। গণমাধ্যমকে মুক্ত করতে হলে অবারিত করতে হবে তার নিজের সীমাবদ্ধতাকে। যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী সাংবাদিকদের গণমাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল জায়গায় সুযোগ দিতে হবে।

একটি অনলাইন জার্নালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক সোমা দেব একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন যে, নারী সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ বলতে বুঝায় এখানে পত্রিকার পাতায় নিউজ ট্রিটমেন্ট পাওয়া, অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়া থেকে শুরু করে এমনকি টয়লেট সুবিধা পাওয়া, রাতে বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ি পাওয়া ও অন্তর্ভুক্ত।

এখানে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ার চিত্রটা একটু ভিন্ন। আবার মিডিয়া হাউস ভেদেও কাজের পরিবেশের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তবে সার্বিকভাবে বলতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ বিটগুলো যেমন- অপরাধ, কূটনৈতিক, পররাষ্ট্র, স্পোর্টস, অর্থনীতি, শিক্ষা এসব বিটে নারী সাংবাদিকদের উপস্থিতি এখনো কম। এসব বিষয়ে নারীদের যোগ্য মনে করা হয় না কোনো এক অজানা কারণে। নারী ও শিশু বিষয়ক বিট, সংস্কৃতি এবং এধরনের সফট বিটগুলোতে নারীরা বেশি কাজ করেন। এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পরিবারকে সন্তানকে সময় দিতে গিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হিমশিম খায়। এক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার থাকা খুব জরুরি।

নারী সাংবাদিকদের মননশীল মেধা, প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে দেশ এবং সমাজের পরিবর্তন আনা সম্ভব। শত বাধা বিগ্নতাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশসহ পৃথিবির অনেক দেশেই নারী সাংবাদিকরা চূড়ান্ত জায়গা দখল করে নিয়েছেন। কাজ করছেন সফলতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে। কিন্তু তার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

তাই নারী সাংবাদিকদের এগিয়ে আসার পেছনে সব বৈষম্য দূবীকরণ করে একটি সৃজনশীল ও উন্নত গণমাধ্যম বিনির্মানে মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায়।

লেখক-শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজকোর্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :