বঙ্গবন্ধুর আদরের এমপির মানবেতর জীবনযাপন

প্রকাশ | ২৫ মে ২০১৭, ০৮:১৮ | আপডেট: ২৬ মে ২০১৭, ১৭:৩৬

আজহারুল হক, গফরগাঁও

বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। গফরগাঁও থেকে দুবার নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর আদরের আবুল হাসেম দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ পড়ে আছেন নিজ বাড়িতে। অনেকটা বিনা চিকিৎসায়। তাকে দেখার কেউ নেই। একসময়ের দাপুটে এক সাংসদের এমন করুণ মানবেতর জীবন দেখে স্তম্ভিত গফরগাঁওয়ের মানুষ।

অভিযোগ উঠেছে পরিবার-পরিজনদের অবহেলার। নিঃসন্তান এই অশীতিপর ও অসুস্থ রাজনীতিক বোঝা হয়ে উঠছেন তাদের কাছে। আ.লীগের একসময়কার ডাকসাইটে এই সাংসদের প্রতি বর্তমান আ.লীগ সরকারেরও কোনো দায়দায়িত্ব নেই বলে মনে হচ্ছে। দল কিংবা সরকার থেকে পাচ্ছেন না কোনো সহায়তা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পশ্চিম গফরগাঁও গ্রামের নিজ বাড়িতে প্রায় দুই বছর ধরে অসুস্থ আবুল হাসেমের দেখাশোনা করছেন তার বৃদ্ধা স্ত্রী, ভাতিজা ও নাতি-নাতনিরা। কিন্তু তার স্ত্রী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে ঢাকায় চিকিৎসাধীন। সাবেক সাংসদের সব সম্পত্তি দলিল করে নিয়ে যাওয়ার গুঞ্জনে স্থানীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা দেখতে যান তাকে। তবে কোনো প্রতিকার হয়নি কোনো।

আবুল হাসেম ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে নৌকা নিয়ে দুবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এলাকায় অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকর্মী থাকলেও এই অসহায় ব্যক্তিটিকে দেখার আগ্রহ নেই কারো। তিনি জীবন কাটিয়েছেন আওয়ামী  লীগের রাজনীতিতে। খদ্দরের ছেঁড়া পাঞ্জাবি, পাজামা, গায়ে মুজিব কোট, মাথায় গান্ধী টুপি দেখে যে কেউ বলে দিতে পারতেন তিনিই গফরগাঁওয়ের প্রিয় হাসেম ভাই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সময় আবুল হাসেম প্রথমে পাড়ি জমান ভারতে। সেখান থেকে পরে অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু যখন বলেছিলেন ‘তিন বছর কিছুই দিবার পারব না’, তখন হাসেম ভাই ডাক দেন ‘শ্রমদান সপ্তাহ’-এর। হাজার হাজার তরুণ ও সাধারণ জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে রাস্তাঘাটসহ বিধ্বস্ত অবকাঠামো গড়ার কাজে। জনতার আগ্রহে পরে শ্রমদান সপ্তাহ পরিণত হয় ‘শ্রমদান মাস’-এ।

১৯৩১ সালের ১৭ আগস্ট জন্ম নেয়া আবুল হাসেম স্কুলজীবনেই ভারতীয় কংগ্রেস দলের ছাত্রসংগঠনের একজন কর্মী হিসাবে যুক্ত হন ছাত্ররাজনীতিতে। বিপ্লবী যুগান্তর দলের কমরেড ফণিলাল বল ছিলেন তার রাজনৈতিক গুরু।

১৯৫০ সালে গফরগাঁও কলেজ প্রতিষ্ঠালগ্নেœ প্রথম ব্যাচের ছাত্র থাকাকালে তিনি ছিলেন ছাত্র সংসদের ভিপি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনের জন্য ঘুরে বেড়ান সারা এলাকায়। ২১ ফেব্রুয়ারি গফরগাঁওয়ের আব্দুল জব্বার ঢাকায় শহীদ হয়েছেন শুনে ছাত্র-যুবকদের এক বিশাল দল নিয়ে ঢাকায় ছুটে যাপন। শহীদ জব্বারসহ ভাষাশহীদদের রক্ত কপালে মেখে দীপ্ত শপথ নিয়েছিলেন এই আবুল হাসেমসহ গফরগাঁওয়ের সঙ্গীয় ছাত্র-যুবকরা।

১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে পরের বছর ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগীর পক্ষে গফরগাঁও-ভালুকা অঞ্চলে ক্যাম্পিং করেন আবুল হাসেম। ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সব আন্দোলনেই একনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি।

১৯৪৬ সালে নেতাজি সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রথম গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন আবুল হাসেম। দ্বিতীয় ও শেষবার কারাবরণ করেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর। তখন বিনা বিচারে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুই বছর জেলে রাখা হয় বঙ্গবন্ধুর আদরের এমপিকে।

আবুল হাসেম সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় গড়ে তোলেন অর্ধশতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, অন্তত ২০টি হাই স্কুল ও গফরগাঁওয়ের একমাত্র মহিলা কলেজ। তার বদৌলতে এলাকার শত শত বেকার যুবকের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি গফরগাঁওয়ে গড়ে তোলেন লঙ্গরখানা। গফরগাঁওয়ের প্রবীণ সাংবাদিক ফকির এ মতিনের পরিচালনায় লঙ্গরখানায় প্রতিদিন শত শত ভূখা অনাহারি মানুষ খাবার খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে।

শুধু রাজনীতিকই নন, সাহিত্য-সংস্কৃতির একজন একনিষ্ঠ সেবক আবুল হাসেম। তারই প্রত্যক্ষ সহায়তায় গফরগাঁওয়ে ১৯৭৫ সালে তটিনী খেলাঘরের মাধ্যমে শুরু হয় সাস্কৃতিক ও শিশু-কিশোর আন্দোলন। হাসেম ভাইয়ের লেখা ‘যখন এম.পি ছিলাম’ বইটি প্রকাশ হয়েছে বছর কয়েক আগে।

আর্থিকভাবে কোনোদিনই সচ্ছল ছিলেন না আবুল হাসেম। বাবার আমলের দুই একর ফসলি জমি ছাড়া এক টুকরো জমিও কিনতে পারেননি। ৮৮ বছর বয়সের জীবনের ৮৫ বছর পৈতৃক ভিটায় নিজের কোনো ঘর নির্মাণ করতে পারেননি তিনি। তার জীবন কেটেছে ভাই-ভাতিজা ও স্ত্রীর ঘরে।

রাজনৈতিক জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৬০ বছর বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও তিনি যেন চিরকুমার। সন্তানহীন এই অসহায় ব্যক্তিটি কোনোদিন  বাবা ডাক শুনতে পাননি। একমাত্র অবলম্বন বৃদ্ধা স্ত্রী, ভাতিজা ও নাতি-নাতনিদের ভালোবাসা। জীবনসায়াহ্নে এসে নিজঘরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আশায় পৈতৃক ফসলি জমির কিছু অংশ বিক্রি করে তিন বছর আগে নির্মাণ করেন ছোট্ট একটি ঘর। এ ঘরেই একটানা শুয়ে কখনো জ্ঞান হারান, আবার কখনো জ্ঞান ফিরে আসে। একাকী স্মৃতিচারণা করেন এই অসহায় মানুষটি। নিত্য অভাবী হাসেম ভাইয়ের খাবার জোটে স্ত্রীর পেনশনের টাকা আর ভাতিজা নাতি-নাতনিদের সহায়তায়।
নিজের এই দুরবস্থার মধ্যে এখনো তিনি স্বপ্ন দেখেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার।

(ঢাকাটাইমস/২৫মে/মোআ)