নৌকাতেই ভরসা রাখব?

কাওসার শাকিল
| আপডেট : ২৬ মে ২০১৭, ১২:০৬ | প্রকাশিত : ২৬ মে ২০১৭, ১১:৪৫

কদিন ধরে ফেসসবুকের প্রোফাইল পিকচারে ভেসে ভেসে উঠছে ভরসা থাকুক নৌকায়। আমার প্রশ্ন, কিন্তু কোনটায়? কোন নৌকায় ভরসা রাখব আমরা? যে নৌকা হেফাজতের ভাষায় কথা বলে? যে নৌকা সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচারকে মুখ বুঁজে সহ্য করে? যে নৌকা রাতের আঁধারে সুপ্রিম কোর্ট থেকে থেমিসের ভাস্কর্য সরায়, সেই নৌকায় ভরসা রাখবো?

কিন্তু কেন?

গেল মাসে সাংবাদিক এবং কলামিস্ট সৈয়দ বদরুল আহসান একটা কলাম লিখলেন, যার সার কথা এই- মুসলীম লীগ থেকে বের হয়ে আসা যে ধর্ম নিরপেক্ষ আওয়ামী লীগকে তিনি চিনতেন, এই আওয়ামী লীগ সে আওয়ামী লীগ নয়। এ আওয়ামী লীগকে তিনি চেনন না না, চানও না।

যে হতাশা থেকে তিনি একথা বলেছেন তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে সারা দেশ। মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা মৌলবাদ, মোল্লাতন্ত্র আর ধর্মান্ধতার প্রশ্নে আপসহীন প্রগতিশীল এই রাজনৈতিক দলটার এমন পরাজয় দেখতে হলো আমাদের! সত্যিই আমাদের ভাগ্যটা ভীষণ খারাপ। তরুণ প্রজন্মকে দলে ভেড়াতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি করছে। এমন বাজে দৃষ্টান্ত তারা রেখে যাচ্ছে যার ফল বহু প্রজন্মকে বহু যুগ ধরে বয়ে বেড়াতে হবে।

সোজা ভাষায় যদি বলি, আওয়ামী লীগ এখন দু্‌ই নৌকায় পা দিয়ে চলছে। হেফাজতের নৌকায় পা রাখা আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে না যে কতবড় রাজনৈতিক ভুল এটা? হেফাজতে ইসলামের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার মত নির্বুদ্ধিতা কেমন করে করছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দাবি করা দলটি?

এখনও মনে আছে, ২০১৩ সালে ঢাকার মতিঝিলে ১৩ দফা দাবির কথা শুনিয়েছিলো হেফাজতে ইসলাম। সেই দাবির ৭ নম্বরটি ছিল, ‘মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।’

হেফাজতে ইসলাম জানে না মূর্তি আর ভাস্কর্যের মধ্যে পার্থক্য কী। এদেশের বহু ধর্মান্ধের মতন তারাও চায় দেশে কোনো 'মূর্তি' থাকবে না। 'বলাকা' ভাষ্কর্যের পা ভেঙে দিয়েছিলো যারা তারাও মূর্তি আর ভাস্কর্যের পার্থক্য বুঝতো না। তা যে ভাষায় কথা বলেছে এতদিন এবার আওয়ামী লীগও কি একই ভাষায় কথা বলবে? পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা করেনি যে আওয়ামী লীগ; সেকি শুধুই নিরাপত্তার ভয়ে, নাকি হেফাজতকে খুশি করতে? এই প্রশ্নের উত্তর খুব জোরের সাথে দিতে পারবেন কি আওয়ামী লীগের কেউ?

আওয়ামী লীগের ক্ষমতার টানা আট বছর চলছে। এই আট বছরে সংখ্যালঘুদের উপর যতবার যতভাবে অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে তা রীতিমত গা শিওরানো। এসব ধরনের ঘটনায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এবং তাদের গঠন করা সরকারের ততটা সক্রিয়তা দেখা যায়নি যেটা খুবই হতাশাজনক। সংখ্যালঘুর প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের যে উদাসীনতা সেটার মাত্রা খুবই অস্বাভাবিক ধরনের অসহনীয়। প্রতিটি ঘটনার পর পরই লোক দেখানো আইন শাসন, বিচারের শাসনের কথা বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দায় সেরেছে সরকার, শক্ত কোনো অবস্থান নেয়নি তারা। রাখেনি সুশাসনের কোনো দৃষ্টান্ত। যে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষ চিনতো তার কাছ থেকে এরকম দুমুখোপনা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

যতটুকু বুঝি আওয়ামী লীগ এখন গড়পড়তায় ক্ষমতায় টেকার রাজনীতি করছে, দেশের মানুষের রাজনীতি না। সেটা তাদের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কদিন আগেই নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন। বলেছেন, আবার ক্ষমতায় না এলে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে দলের সবাইকে। তার কারণ? দেশের স্বার্থে রাজনীতি করলে এই ভীতি তাদের জন্য অমূলক হয়ে যেত। যেহেতু হয়নি, তাই দলটির জন্য সামনের দফায় ক্ষমতায় আসা ছাড়া পিঠ বাঁচাবার আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। আর ক্ষমতায় আসতে যদি হেফাজতের কাধে ভর করতে হয়, আওয়ামী লীগ কি সেটাই করবে?

হেফাজতের কথায় পাঠ্যবই পাল্টানো, হেফাজতের কথায় হাইকোর্টের ভাস্কর্য নামানো, এসব হয়তো তারই প্রাথমিক প্রস্তুতি। এরপর হেফাজত মদীনা সনদের ভিত্তিতে দেশ চালানোর দাবি নিয়ে এলে আওয়ামী লীগ ভালোয় ভালোয় সেটাও হয়ত মেনে নেবে।

শেষ করি আহমদ ছফার একটা কথা দিয়ে। তিনি বলছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু আওয়ামী লীগই জেতে। আর তারা হারলে সমগ্র দেশ ও জাতি হেরে যায়।’

আমার মনে হয় না আজকের এই আওয়ামী লীগ আহমদ ছফার কথাটার মানে জানে। তবে নিজেদের হারিয়ে দিয়ে দেশকে হারানোর যে আত্মবিধ্বংসী খেলায় তারা মেতে উঠেছে, এর ফল ভালো হবে না। না তাদের জন্য, না দেশের জন্য।

লেখক: জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :