কোন্দলে ভরা সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগ

কমরেড খোন্দকার, ইউরোপ ব্যুরো প্রধান
| আপডেট : ২৮ মে ২০১৭, ১৪:২৯ | প্রকাশিত : ২৮ মে ২০১৭, ০৯:০০

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যে উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা নিয়ে ২০০১ সালে সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগ গঠন করছিলেন তার সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন সংগঠনের নেতারা। দলের সভাপতি অনিল দাশ গুপ্ত ও সাধারণ সম্পাদক এম এ গনির ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে সংগঠনটির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। মূলত প্রধানমন্ত্রীর ইউরোপ সফরের সময় তাদের বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা যায়। বাকি সময়টা তাদের খুঁজেও পান না বিভিন্ন দেশের নেতাকর্মীরা।

অন্যদিকে দলের সভাপতি অনিল দাশ গুপ্ত সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সময় না দেয়ায় এর সুযোগ নিচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক এম এ গনি। তিনি বিভিন্ন দেশে একটি বৈধ কমিটি থাকার পরও হাইব্রিডদের দিয়ে একেক দেশে পাল্টা কমিটি দিয়ে দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছেন। অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে ইউরোপে দলের ত্যাগী নেতাদের। অতি সম্প্রতি সুইডেন, বেলজিয়াম, হল্যান্ড ও গ্রিসে পাল্টা কমিটি করে বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে।

সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া আক্ষেপ করে বললেন এসব কথা। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া দায়িত্ব পালনে আমরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছি।’ তাই প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভিয়েনা সফরকে কেন্দ্র করে গুঞ্জন শোন যাচ্ছে, তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত ঘোষণা করছেন, নাকি ঢেলে সাজাবেন আওয়ামী লীগের এই বৃহৎ প্রবাসী ইউনিটকে।

এর মধ্যেই আবার সমবেত হচ্ছেন ইউরোপের আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীর অস্ট্রিয়া সফরকে কেন্দ্র করে ইউরোপের প্রতিটি দেশের নেতাকর্মীরা ভিয়েনা যাচ্ছেন। ইউরোপে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে উপযুক্ত নির্দেশনার অপেক্ষায় বারবার হোঁচট খাওয়া ত্যাগী নেতারা এবার আশার বাণী শুনতে চান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দলের অভ্যন্তরীন কোন্দল মিটিয়ে আওয়ামিী লীগকে শক্তিশালী করে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি দেশ থেকে নেতারা কীভাবে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ভূমিকা রাখবেন, এ ব্যাপারে নির্দেশনা আশা করছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতাকর্মীরা।

নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগে বিভক্তি, কোন্দল, গ্রুপিং এবং একাধিক কমিটির কারণে সংগঠনটি কোথাও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগের একাধিক কমিটির জন্যও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগকেই দায়ী করছেন। কোন্দল-গ্রুপিং মেটাতে তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ইউরোপে আওয়ামী লীগের শক্তি বৃদ্ধি নয় বরং দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো সম্মেলন না হওয়ায় দলীয় কোন্দল-গ্রুপিং বাড়ছে।

ডেনমার্ক

ডেনমার্ক আ.লীগে রয়েছে ৩টি গ্রুপ। মোস্তফা মজুমদার বাচ্চুকে সভাপতি ও মাহবুবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে এক গ্রুপ; অন্যদিকে সম্প্রতি সন্মেলনের মাধ্যমে মো. লিন্কন মোল্যা সভাপতি ও সাব্বির আহম্মেদ সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডেনমার্কে আওয়ামী লীগের আরো একটি কমিটি আছে- সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনি সমর্থিত ইকবাল-বিদ্যুৎ বড়ুয়ার কমিটি। শুধু এই কমিটিই এম এ গনির অনুমোদিত। বাকিদের কে বা কারা অনুমোদন দিয়েছে তার কোনো সঠিক তথ্য প্রমাণ দেখাতে পারেনি কেউ।

ফ্রান্স

ফ্রান্স ইউরোপে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কয়েক লাখ প্রবাসী অধ্যুষিত দেশটিতে সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগ সভাপতি অনীল দাশগুপ্ত ও সাধারণ সম্পাদক এম এ গনির উপস্থিতিতে কাউন্সিল হয়। কমিটি গঠন নিয়ে দুই গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মহসীন উদ্দীন খান লিটনকে সভাপতি ও দেলোয়ার হোসেন কয়েছকে সাধারণ সম্পাদক করে নাম ঘোষণা করা হয়। পরে কাশেম-মজিব গ্রুপ আরো একটি কমিটি ঘোষণা করে। সম্প্রতি প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে অপ্রীতিকর ঘটনার অভিযোগে উভয় কমিটির সব কাযর্ক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

ইতালি

ইতালিতে ২০১২ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে অনেক নাটকীয়তায় মো. ইদ্রিস ফরাজী সভাপতি এবং হাসান ইকবালকে সাধারণ সম্পাদক করে এক বিশাল কমিটি ঘোষণা করা হলেও প্রধান প্রধান কয়েকটি পদ ছাড়া অন্য পদে কে বা কারা রয়েছেন আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। ইতালিতে আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও ভেতরে ভেতরে কয়েকটি গ্রুপ আছে। তারা সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে ঢাকাটাইমসের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তারা বলেন গত ফেব্রুয়ারি মাসে সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনি দুই মাসের মধ্যে সম্মেলন করার জন্য চিঠি দিলেও এখনো তারা সম্মেলন করার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ ব্যাপারে জানতে শুক্রবার ইতালি আ.লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কয়েকবার ফোন করেও তাদের সাথে কথা বলা যায়নি।

বেলজিয়াম

বেলজিয়াম আওয়ামী লীগ সভাপতি বজলুর রাশিদ বুলু ও সাধারণ সম্পাদক পলিন মনির থাকলেও সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনি সম্প্রতি শহিদুল হককে সভাপতি ও জাহাঙ্গীর চৌধুরী রতনকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটি ঘোষণা দিয়েছেন।

হল্যান্ড

হল্যান্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মুহিত ফারুক (অব্যাহতি প্রাপ্ত) ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান। সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনি সম্প্রতি শাহদত হোসেন তপনকে সভাপতি ও মুরাদ খাঁনকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটি ঘোষণা করেন।

পর্তুগাল

পর্তুগাল আ.লীগের কমিটির মেয়াদ চলতি মাসেই শেষ হয়েছে। পর্তুগাল আ.লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম জসিম জানান, ঈদের পরেই পর্তুগাল আ.লীগের সম্মেলন করা হবে। সভাপতি পদে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সভাপতি জহিরুল ইসলাম জসিম, মাহবুব আলম, আবুল বাশার বাদশা, ফরহাদ মিয়া, মোহাম্মদ মহসিন হাবিব, এম এ খালেক এবং সাধারণ সম্পাদক পদে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শওকত ওসমান, আবুল কালাম আজাদ, এ কে রাকিব, খন্দকার রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।

জার্মান

সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সভাপতি অনিল দাশ গুপ্ত জার্মানে বসবাস করেন। আর সেই জার্মানেই রয়েছে আ.লীগের দুই গ্রুপ। এক গ্রুপে সভাপতি এ কে এম বশিরুল আলম চৌধুরী সাবু, সাধারণ সম্পাদক শেখ বাদল আহমেদ। অন্য গ্রুপে আনোয়ার কবির, জাহিদুল ইসলাম পুলক ও রতন।

সুইডেন

সুইডেন আ.লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি থাকলেও সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনি সম্প্রতি সম্মেলনের মাধ্যমে মনজুরুল হককে সভাপতি ও লাভলু মনোয়ারকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটি ঘোষআ দিয়েছেন।

সুইজারল্যান্ড

চলিত মাসের ২১ তারিখে সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনির নেতৃত্বে সুইজারল্যান্ডে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে তাজুল ইসলাম সভাপতি এবং শ্যামল খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তবে সাধারণ সম্পাদক পদে দুই প্রথীর ভোট সমান হলেও কারচুপির মাধ্যমে শ্যামল খানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। এ সম্মেলন নিয়ে এখনো চলছে তুমুল বাগবিতণ্ডা।

স্পেন

স্পেন আওয়ামী লীগের বৈধ কমিটির সভাপতি শাকিল পান্না ও সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম নয়ন থাকার পরেও গত ১৫ মে সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনির নেতৃত্বে স্পেন আওয়ামী লীগের দুলাল সাফা ও রিজভী আলমকে দিয়ে সম্মেলন করতে গেলে নেতাকর্মীদের প্রতিরোধের মুখে সম্মেলন বানচাল হয়ে যায়।

আয়ারল্যান্ড

আয়ারল্যান্ডেও আ.লীগের রয়েছে তিনটি গ্রুপ। এক গ্রুপে সভাপতি রফিক খান ও সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল্লাহ সিকদার। অন্য গ্রুপে কিবরিয়া হায়দার ও বিল্লাল হোসেন। এ ছাড়া ইকবাল আহম্মেদ লিটন ও জসিম উদ্দীনের নেতৃত্বে রয়েছে আর একটি গ্রুপ।

নরওয়ে

নরওয়ে আ.লীগের এক গ্রুপে রয়েছে সৈয়দ ইফতেখার টিটু ( সভাপতি), বিদ্যুৎ কার্ল (সাধারণ সম্পাদক) ও মিরাজ হোসেন (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক)। অন্য গ্রুপে নুরুল আমিন (সভাপতি) ও মফিজুর রহমান (সাধারণ সম্পাদক)। সম্প্রতি এক মন্ত্রী নরওয়ে সফরে গেলে তাকে কে আগে ফুল দিয়ে বরণ করবে তা নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি হয়, যা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়।

গ্রিস

গ্রিসে আ.লীগের মান্নান মাতুব্বর সভাপতি ও বাবুল হাওলাদার সাধারণ সম্পাদক থাকার পরেও গত ১০ মে সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনি সম্মেলনের মাধ্যমে রাকিব মৃধাকে সভাপতি এবং মিজানুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটি ঘোষণা করে।

অস্ট্রিয়া: অস্ট্রিয়া আ.লীগের এক গ্রুপের সভাপতি নাসিম ও সম্পাদক সাইফুল কবির। অন্য গ্রুপে সভাপতি শাহ মোহাম্মদ ফরহাদ ও সম্পাদক আহমেদ ফিরোজ।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগের কয়েক লাখ সমর্থক থাকলেও অভ্যন্তরীন কোন্দলের কারণে মোটামুটি সব দেশেই কমবেশি সমস্যা রয়েছে। ইউরোপে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা বন্ধ করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে প্রচারণা বন্ধ করাসহ সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ এসব বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষে তেমন কোনো কাজে আসেনি।

ইউরোপে আওয়ামী লীগ কার্যত শুধু নামেই আছে। প্রবাসীদের কল্যাণে কিংবা বাংলাদেশের কল্যাণে তেমন কোনো উল্লেখ করার মতো ভূমিকা রাখতে পারছে না মূলত অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে। সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও সম্প্রতি প্রশ্ন উঠেছে। পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এই সংগঠনের কার্যত কোনো কার‌্যক্রম নেই।

এ ব্যাপারে সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের প্রবাস কল্যাণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার হাসনাত মিয়া বলেন, মূলত সর্ব ইউরোপিয় আওয়ামী লীগের নির্দিষ্ট কোনো গঠনতন্ত্র না থাকায় বিভিন্ন দেশে একের অধিক কমিটি গঠিত হচ্ছে।

সর্ব ইউরোপিয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম হক বলেন, বিভিন্ন দেশে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে দলের মধ্যে একাধিক গ্রুপ দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে দলের প্রয়োজনেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ ব্যাপারে জার্মানে সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সভাপতি অনিল দাশ গুপ্ত এবং যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সর্ব ইউরোপিয়ান আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনিকে বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

(ঢাকাটাইমস/২৮মে/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :