পথশিশুদের জীবনের আলো ‘স্ট্রিট লাইট’

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৮ মে ২০১৭, ১৩:০৭ | প্রকাশিত : ২৮ মে ২০১৭, ১১:৩৪

২৫ মার্চ। কয়েকজন স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী ভাবল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে ভীষণভাবে জড়িয়ে থাকা এ দিনটাকে নিজেদের জন্যও স্মরণীয় করে রাখবেন। এমন কিছু করবে তারা সেটা যেন মানুষের জীবনে আলো এনে দেবে। বদলে দেবে তাদের বেঁচে থাকার ধরণটাকেই।

তারা ভাবল একটা স্কুল করার কথা। এই স্কুল তাদের জন্য, যাদের স্কুলে যাবার স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই, সত্যি আর হয় না। সেই স্বপ্ন দেখতে বিভোর হয়ে থাকা জনা কয়েক তরুণ-তরুণীর সেদিনের সেই ভাবনার ফসল ‘স্ট্রিট লাইট’ মানে রাস্তার আলো।

‘স্ট্রিট লাইট’ একটা স্কুল। আরও ভালো করে বললে পথশিশুদের জন্য গড়া একটা স্কুল। স্কুলটা যেহেতু পথশিশুদের জীবনে আলো আনবে তাই এমন নাম। সেই যে শুরু হয়েছে, সেই থেকে চলছে। মে মাস পর্যন্ত সময়টা খুব বেশি না হলেও শুরুর ধাক্কা সামলানোই যে দায়।

তারপরও আপনমনে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তারা সবাই। চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা থেকে বষ্ণিত এসব শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার নিরন্তর চেষ্টা। সুযোগ পেলে পথশিশুরাও এগিয়ে যেতে পারবে এই ব্রত নিয়ে তারা কাজ করে চলেছেন ক্রমাগত।

বলছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের সংগঠন ‘স্ট্রিট লাইটের’ কথা। যারা মূলত পথশিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে। নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টায় এই মহৎ কাজের পেছনে অর্থের যোগানও দিচ্ছে স্বপ্নবাজ এই মানুষগুলো।

যেভাবে ‘স্ট্রিট লাইটের’ সন্ধান পাওয়া গেলো একেবারেই কাকতালীয়। শনিবার বেলা ১১টায় পেশাগত কাজে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে যেতে রাজু ভাষ্কর্যের উল্টো দিকের গেইট দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকতেই চোখ আটকে গেলো একটা জটলা দেখে। কাছে যেতেই দেখা যায় গোল বেদীর ওপর বসে কয়েকজন তরুণ এক একটা বাচ্চাকে হাতে ধরে লেখা শিখিয়ে দিচ্ছেন। কেউ আবার বই পড়াচ্ছেন। পাশে আবার দুই জন বসে হাজিরা খাতা জাতীয় কিছুতে লেখালেখি করছেন।

এরপাশেই দুজন ছেলে এবং দুজন মেয়ে পাটিতে বসে একইভাবে কেউ চক স্লেট দিয়ে লেখা শেখাচ্ছেন। একজন আবার ছোট আওয়াজে বই পড়ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে একজন তরুণী ধমকের সুরে শিশুদের একজনকে লক্ষ্য করে দুষ্টুমি না করার জন্য বলছেন।

জানা গেল, এরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নিজেদের পড়াশোনার ফাঁকে এসব পথশিশুদের পড়াচ্ছেন। বই খাতা কিনে দিচ্ছেন। পড়ার পরে আবার নাস্তার ব্যবস্থাও করছেন।

এমন উদ্যোগের কথা শুনে মুহূর্তেই ভালো লেগে যায়। মনে হলো, পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে কর্মজীবনে চলে আসলে এমন চিন্তা তো আমাদের মাথায় হয়তো আসেই না। তাই আগ্রহ ভরে জানতে চাওয়া তাদের আদি-অন্ত। যদিও এখনই নিজেদের কাজকর্ম ফলাও করে প্রচার করতে ভীষণ অনীহা ছিলো তাদের।

সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয়। এর মধ্যে উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, নাম আকরাম। জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাদের কয়েকজনের মাথায় পথশিশুদের জন্য কিছু করা যায় কি না এমন চিন্তা আসে। পরে কাছের বন্ধুদের সঙ্গে একে অন্যের আলাপ শুরু হয়। একপর্যায়ে সবাই আগ্রহী হলে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হয়।

আকরাম ঢাকাটাইমকে বলেন, ‘আমাদের সবার বিশ্বাস একটু সুযোগ পেলে এই পথশিশুরাও শিক্ষার আলো ছড়াতে পারবে। তাই আমরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছি। অনেক প্রতিকূলতা থাকলেও আমাদের এই স্বপ্নপূরণ হবে সবার এই আত্মবিশ্বাস আছে।’

যেভাবে চলছে কার্যক্রম

সংগঠনের সদস্যরা ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ জন গোটা কার্যক্রমে নিজেদের সক্রিয় রাখলেও তালিকাভুক্ত সদস্য সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে এর মধ্যেই। এদের মধ্যে কেউ আছেন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। কেউ আবার ডোনার। সাধ্যের মধ্যে নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা দিয়ে সংগঠনের কার্যক্রমকে তরান্বিত করছেন তারা। তবে কোনো জোরজবস্তি নেই। নেই কোনো পদ পদবি। তাদের ভাষায়, ‘আমরা সবাই মিলে এক।’ মজার বিষয় এরা যে যাই হোক সবাই ছাত্র।

শনিবার এদের অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ নেই। যে কারণে পথশিশুদের পড়ানোর জন্য এই দিনকেই তারা বেছে নিয়েছেন। প্রতি শনিবার সকালে তারা নিয়ম করে পড়াশোনা করান সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের। এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থী ১০ জন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পড়ানোর দায়িত্বে থাকেন একজন করে।

এদের মধ্যে দুইবোন জান্নাতুল ফেরদাউসী ও উম্মে সাদিয়া কামরাঙ্গীরচরের ওরিয়েন্টিয়াল ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। পঞ্চম শ্রেণি সাময়িকীতে এদের একজন জিপিএ-ফাইভ পেয়েছে অন্যজন সামান্য নম্বরের জন্য জিপিএ-ফাইভ পায়নি।

সাদিয়া ও ফেরদাউসীর মা কোহিনুর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফুল বিক্রি করে সংসার চালান। তিনি বলেন, ‘চাইর বাচ্চার মাসে বেতন আটশ। দুই মাইয়ার কোচিংয়ের ট্যাহা। আমরা গরিব মানু কেমনে চালামু। এজন্য ওরা এইহানে পড়ে। অনেক মন দিয়া পড়ায়। কোচিংয়েও এমন পড়ায় না। একজন ছাত্রের লাইগা একজন স্যার। আল্লায় হ্যাগো মনের আশা পূরণ করুক।’

সাদিয়াকে পড়াচ্ছিলেন এমন সময় কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিনা ইসলাম ইভার সঙ্গে। কেন এই স্কুল পড়াবার চিন্তা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ওদের পাশে থাকতে পেরে আমি গর্বিত। ও অনেক মেধাবী স্টুডেন্ট। ভালো গাইড পেলে ভালো কিছু করবে ইনশাল্লাহ।’

এই সময়টুকু অন্য কোথাও দিলে হয়তো আর্থিক সুবিধা পাওয়া যেত- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসলে সবকিছু ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। আমি অন্য কাজের মধ্যেই এই সময়টুকু বের করে রাখি। আর সবকিছুতে আর্থিক চিন্তা করলে চলে না। এখানে সময় দিয়ে যে তৃপ্তি পাই, অন্য কোথাও সেটা পাব না।’

উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও আন্তর্জতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী। ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সবাই মিলে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। সবার সহযোগিতা পেলে আশা করি অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।’

মেহেদী আরো বলেন, ‘রমজানে আমাদের কার্যক্রম সাময়িক ব্যঘাত ঘটতে পারে। অনেকে হয়তো ঢাকায় নাও থাকতে পারেন। যে কারণে ৩০ মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে একসঙ্গে ইফতার করব। আর ঈদের আনন্দ থেকে শিশুরা যাতে বঞ্চিত না হয় এজন্য ওদের নতুন পোশাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

(ঢাকাটাইমস/২৮মে/বিইউ/কেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :