ভিআইপিরা রাস্তা আটকে না চললেই সমাধান হতে পারে যানজটের

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
 | প্রকাশিত : ২৮ মে ২০১৭, ১১:৫২

বেশ অনেক আগে প্রখ্যাত সাংবাদিক আবেদ খান দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ যাত্রাকালে বিমান বন্দরে বিদায় ও স্বাগতম জানাতে ঢাকার রাস্তায় সৃষ্টি হওয়া যান জোট সমস্যা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। লেখাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। কিন্তু তার সেই অনুরোধের পুরোপুরি বাস্তব প্রতিফলন এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত নয়।

যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে জনভোগান্তির কথা বিবেচনা করে বিমানবন্দরে দল কর্তৃক আয়োজিত অভ্যর্থনা কর্মসূচি বাতিল করেছেন। তবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ যাত্রাকালে বিমানবন্দরে মন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানসহ ভিআইপিদের দ্বারা বিদায় ও স্বাগতম জানানোর প্রথা এখনও বহাল রাখা হয়েছেl

রাষ্ট্র প্রধানদের এভাবে বিমানবন্দরে বিদায় ও শুভাগমন প্রথা শুরু হয়েছিল সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। পাকিস্তান সরকারও ইংরেজদের রেখে যাওয়া এই নিয়মকে অনুসরণ করেছে। এইসময় আমরা দেখেছি আজম খান, মোনায়েম খান, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বিমানবন্দরে সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অভ্যর্থনা ও বিদায় জানাতে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু গণভবনে একসময় কোথায় কোথায় এধরনের প্রচলন রাখা আর না রাখার ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন। বিষয়টিকে তিনি সীমিত করে আনতে চেয়েছিলেন। তবে পরবর্তিতে সরকারিভাবে কোনো নির্দেশ জারির পূর্বেই ঘটে যায় বেদনাদায়ক পচাত্তরের হত্যাকাণ্ড।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান ও হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এ ব্যাপারে কখনো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এমনকি পরবর্তিতে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার আমলেও কখনো বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা ও বিদায় জানানোর বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

এভাবেই দীর্ঘ দিন থেকে চলে আসছে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রের ভিআইপিদের দ্বারা বিমানবন্দরের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিকে অভ্যর্থনা/বিদায়ের অনুষ্ঠান। এখন প্রশ্ন হলো, এধরনের লৌকিকতার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি?

শুরুতেই সাংবাদিক আবেদ খানের যে কথা বলেছিলাম, তিনি জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে এধরনের অনুষ্ঠান বাতিল করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনভোগান্তির কথা বিবেচনা করে পরবর্তীতে এ ধরনের কর্মসূচি বাতিল করেছেন। এজন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখেন। জানি না শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আবেদ খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগকে প্রশংসা করে পরবর্তীতে কোনো লেখা লিখেছিলেন কি না। তবে ভিআইপিদের দ্বারা নেওয়া বিদায় ও স্বাগতম রীতি এখনো বহাল রাখা হয়েছে।

এধরণের নিয়ম বাতিল করার ব্যাপারে আজ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে আদৌ নেওয়া হবে কি হবে না তা সরকারের উপর নির্ভর করছে।

রাজধানী ঢাকার বর্তমানে যে ট্রাফিক অবস্থা সেখানে ভিআইপিদের জন্য দীর্ঘ সময় রাস্তা আটকানো জনগণের জন্য নিয়ে আসে এক বিরাট দুর্ভোগ। ভালো-মন্দ দেখার সময় এখানে নেই। রাজনীতি যারা করেন তারা তো জনগণের প্রতিনিধি। তাদের প্রধান দায়িত্ব জনগণের সেবা করা। যে ব্যবস্থা জনগণকে কষ্ট দেয়, হয়রানি করে, দুর্ভোগে ফেলে, তা কখনই একজন রাজনীতিবিদের কাম্য হতে পারে না।

ভিআইপি যাতায়াতে ঢাকার রাজপথকে যেভাবে আটকে রাখা হয় তাতে দেখেছি জনগণকে শুধু ধিক্কার দিতে। কষ্টের জন্য নীরবে প্রতিবাদ জানাতে। সরকারের উপর নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে। ভেবে দেখুন এইসময় অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া একজন জটিল রোগীর কথা।

যারা জনগণের জন্য রাজনীতি করেন বলে নিজেদের অবস্থানকে তুল়ে ধরেন তাদের জনগণের ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব অনেক। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলে মুহূর্তের মধ্যে বৃটিশের রেখে যাওয়া এই পুরানো নিয়ম বাতিল করতে পারেন। শুধুমাত্র বিমানবন্দরে স্বাগতম ও বিদায় অভ্যর্থনাই নয়, ভিআইপিদের ঢাকার রাজপথে প্রটেকশনের নামে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় তারও ইতি টানতে হবে। ভিআইপিদের সাধারণের মতো অফিসে যেতে কত সময় লাগে তার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই তারা বুঝতে পারবেন আসল পরিস্থিতি। একমাত্র তখনি হয়তো সম্ভব হবে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি করা।

জনগণের ভালবাসা ও সমর্থন পেতে হলে সরকারকে বিষয়টি নিয়ে একবার ভেবে দেখা উচিত। কারণ তারা জনগণের প্রতিনিধি। প্রতিদিন জনগণকে রাস্তায় দুর্ভোগে ফেলে প্রটেকশনের নামে এধরনের কাজ আদৌ যুক্তিসঙ্গত কি না তা সরকারকে ভেবে দেখা উচিত।

পশ্চিমা দেশে প্রধানমন্ত্রীদের বিদেশ সফরের সময় বিমানবন্দরে অফিসিয়ালি কোনো অনুষ্ঠান করার নিয়ম নেই। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রিটেনসহ বিশ্বের অনেক দেশে এধরনের অনুষ্ঠান করতে দেখা যায় না। প্রধানমন্ত্রী কখন কোথায় যান তা টেলিভিশনেও দেখানো হয় না। শুধুমাত্র দৈনিক পত্রিকার কোনো কোনো পাতায় ছোটো করে সংবাদ প্রচার করা হয়।

তবে কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সফরে এলে কখনও কখনও টেলিভিশনে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনার দৃশ্য প্রচারিত হয়, তাও কদাচিত। তাও নির্ভর করে সফরের গুরুত্বের উপর। সাধারণ জনগণ যা জানতে পারে কিংবা দেখতে পারে তা হলো দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক ও তার ফলাফল। শুধু এইটুকুই।

এছাড়া কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সফরে এলে কোনো কোন রাস্তা দিয়ে বিমানবন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে তা জনগণকে আগে থেকেই রেডিও মারফত জানিয়ে দেওয়া হয়। এজন্য রাস্তা বন্ধ করে জনগণকে কষ্ট দেওয়া হয় না। তবে একমাত্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামার স্টকহল্ম সফরের সময় দেখেছি রাস্তা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে রাখতে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার উপর গুরুত্ব দিয়ে সুইডিশ সরকার এ ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ইউরোপের মন্ত্রী-এমপিদের কোনো নিজস্ব গাড়ি নেইl তারা যাতায়াত করেন জনগণের সাথে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেl

ইউরোপে ভিআইপি অতিথিদের বিমানবন্দরে যাতায়াতকালে রাস্তায় রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ও সিভিল পুলিশকে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। এজন্য পুরো রাস্তা কখনোই বন্ধ করা হয় না। পুলিশ এসকর্ট নিয়ে চলার সময় রাস্তার অন্যান্য গাড়ি পাশ কেটে রাস্তা ছেড়ে দেয়া অথবা পাশ কেটে দাঁড়িয়ে থাকে। কিংবা এক রাস্তা বন্ধ করে অন্য রাস্তা খোলা রাখে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি যখন ইউরোপ সফরে আসেন তখন নিশ্চয় এই নিয়ম তাদের দৃষ্টিতে পড়েছেl।

ভিআইপিদের নিরাপত্তার জন্যই যদি এধরণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে তাহলে জনগণের কথা চিন্তা করে এর বিকল্প সরকারকে বের করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হলে আগে থেকেই সিভিল পোশাকে রাস্তায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা যেতে পারে। বর্তমানে যা করা হয় তা পর্যাপ্ত নয়। সংখ্যা বাড়িয়ে রাস্তা পুরোপুরি নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখলেই তো হয়। ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ভ্রমণে গিয়ে দেখেছি ঢাকার রাস্তার প্রশস্থতা। সুতরাং আইনকে শক্তিশালী করলে এধরণের নিয়ম ঢাকায় চালু করা কোনো কঠিন হবে না বলে আমি মনে করিl

যেদিন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা ঢাকার রাস্তায় কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে নিজ নিজ অফিসে যাতায়াত করবেন সেদিন কিছুটা হলেও জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হবে। অন্যদিকে রাস্তায় যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম কাজ করছে তার সমাধানের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবেl

অতীতে সরকার থেকে বার বার উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও এপর্যন্ত কোনো ইতিবাচক অবস্থা লক্ষ্য করা যায়নি। জনগণ ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি দেখতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে এখন সকলের দৃষ্টিl পারবে কি বর্তমান সরকার জনগণের এই দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ মোচন করতে?

লেখক: সুইডেনে মূলধারার রাজনীতিতে জড়িত

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :