পাল্টাপাল্টি রাজনীতি ও একজন শেখ মুজিবের অপেক্ষায়...

অনুপম মাহমুদ
| আপডেট : ২৮ মে ২০১৭, ১৬:০৪ | প্রকাশিত : ২৮ মে ২০১৭, ১২:২৭

দিনের শেষে রাত আসে, সূর্য ডূবে গেলে চাঁদ উঠে। দুঃখের পরে আসে যেমন সুখ তেমনি হাসির পরে কান্না। এই পাল্টাপাল্টি সহাবস্থানেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু রাজনীতিতে এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানে উত্তপ্ত কেবল রাজপথ নয়, ঝড় উঠে চায়ের কাপেও। এই দলীয় অন্ধবিশ্বাস ও অতিভক্তি ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয় ভাইয়ের হাত। আততায়ীর নিশানায় মায়ের কোল শূন্য হয়। স্ত্রী হারায় স্বামী আর আর সন্তান হয় পিতৃহীন। আগুনে গোলায় ঝলসে মরে নিরপরাধ নার-নারী এমনকি শিশুরাও। স্কুলঘরের বেঞ্চগুলো পুড়ে কয়লা হয়। রেললাইনের সমান্তরাল পাতগুলো উঠে আসে অজানা আক্রোশে।

জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস, তাই জনরায় যাদের পক্ষে আসে রাষ্ট্র শাসন করার অধিকার অর্জন করে তারা। তাই জনগণকে পক্ষে রাখতেই হবে। এখানে নীতি নৈতিকতার অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে করে তুলছে ক্রমেই সংঘাতপূর্ণ। যে কোন মূল্যে জনরায় নিজেদের অনুকূলে নিতে চলে প্রচার প্রপাগান্ডা। এখানেই সমস্যার বীজ রোপিত বোধ করি।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এটাকে ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তথা বিশেষ একটি ধর্মের ও দেশের চর বলে প্রচার করা হয়েছিলো। আর এই প্রপাগান্ডায় এই দেশীয় কিছু ধর্মভীরু কাপুরুষ হাত মিলিয়ে এক সাগর রক্তের যোগান দিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনীসহ অগুণতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল উপদলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিলো রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তি কমিটি। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একটি পক্ষ এখানে জিতবে, তাই সকল ষড়যন্ত্র আর প্রতিকূলতাকে জয় করে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় ছিনিয়ে নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

স্বাধীনতার পর দেশে একচেটিয়া ক্ষমতার বলয় ভেঙে প্রয়োজন ছিল নতুন একটা শক্তির। ১৯৭০ এর একচেটিয়া বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জনে আওয়ামী লীগের হাতে তখন নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট। এই সুযোগে যুদ্ধে বিপর্যস্ত অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ একটি অংশ ও অপরাপর রাজনৈতিক দল মিলে বিক্ষোভে নামে, গণবাহিনী তৈরি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বানিয়ে জাতির জনকের হত্যার পথকে সুগম করে দেয়। একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে এই হত্যায় যারা সেদিন সহযোগিতা করেছিল, তাদের একটা অংশ বঙ্গবন্ধুর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল বলে এতোদিন ফিসফাস হলেও এইবার বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রকাশ্যেই এই অভিযোগ তুলেছেন। আর সেদিন যারা উল্লাস করেছিলো বলে অভিযোগ আছে, তারাও এখন আওয়ামী লীগের সাথে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন।

তবে আওয়ামী লীগের ভীত কাঁপিয়ে দিয়ে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে হাজার হাজার নেতাকে জেলে পুড়ে সামরিক ছাউনি থেকে উঠে এলেন মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠকারী সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ধানে জাতির একজন কাণ্ডারী ভীষণ প্রয়োজন ছিলো, তাই এই সমর নায়ককেই বেছে নিল কেউ কেউ। তিনি ডান, বাম, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, আমলা, ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে তৈরি করলেন বিএনপি। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, কয়েক বছরের মধ্যেই সামরিক বাহিনীর আরেকদল বিপথগামী হত্যা করে জিয়াউর রহমানকে।

জিয়া হত্যায় যাকে সন্দেহ করা হয় সেই হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবার এলেন ক্ষমতার মসনদে। তিনিও একই কায়দায় জাতীয় পার্টি জন্ম দিলেন। নয় বছরের শাসনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের বিপরীতে টিকতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করলেন। স্বাধীনতার ২০ বছর পরে শুরু হলো কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক পথচলা।

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে জামায়াতকে কাছে টানে। উল্লেখ্য যে এই জামায়াতকে স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো ধর্মীয় রাজনীতির জন্য। তবে বহুদলীয় রাজনীতির আড়ালে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ২১ বছরের পর। ক্ষমতায় এসে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও জাসদ (রব) কে নিয়ে ঐক্যমতের সরকার গড়ে তোলে। তবে ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন আমাদের মোটা দাগে দুটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দেয়। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় ঐক্যজোটের বিপরীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে উঠে ১৪ দলের সমন্বয়ে মহাজোট।

এই জোট মহাজোটের বাইরে বাম দল গুলো আছে, আছে আরো কিছু দল যদিও ভোটের রাজনীতিতে তাদের খানিকটা হলেও প্রভাব আছে। আর এই সুযোগে বর্তমান সরকারের শরীক ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ৫৮ টি দল নিয়ে আরো একটি জোট করেছে। এর বাইরে হেফাজত ইসলাম বেশ জোড়ালো ভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের অস্তিত্ত্ব জানান দিচ্ছে। মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে পাল্টা শোডাউনের অন্য শাপলা চত্বরে সংগঠিত হয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

এই পাল্টাপাল্টির শুরুটা হয়েছিলো জাতির জনক এর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষককে সমকক্ষ করে তোলার প্রপাগান্ডার মাধ্যমে। সেটা এখনও আছে, আবার এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বিশেষণশূন্য করার জন্য একটা প্রচারণা করা হয় যে, মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)। তাই বাঙালি জাতি বলে কিছু নেই...

ইদানীং সেই ধারাবাহিকতা দেখা দিচ্ছে ফেইসবুকের প্রোফাইল পিকচার নিয়ে। আওয়ামী সমর্থকেরা ব্যবহার করছে ‘ভরসা রাখুন নৌকার উপর’ আর এর পাল্টা প্রোপিক এসেছে ‘ভরসা রাখুন আল্লাহর উপর’। ভার্চুয়াল জগতে এটা নিয়ে রীতিমতো সাইবার যুদ্ধ চলছে।

সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করছেন। আওয়ামী লীগ বলছে, এটা তাদের রূপকল্প ২০৪০ থেকে চুরি করা। বিএনপি মৌলিক কিছু করেনি। এমনকি নির্বাচনের সময়ে দেয়া ইশতাহার নিয়েও একই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আছে, যা নতুন কিছু নয়। এখানে এমন একটা ধারা গড়ে উঠছে যে ভালো কিছু অনুসরণ করাটাও চুরির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তবে কিছু কিছু ব্যাপারে একটা অদ্ভুর মিল আছে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। আর সেটা হলো তাদের জোটের বাইরে যারা আছে, তাদের নিজেদের বলয়ে নিয়ে নেয়া বা আস্থায় আনার প্রয়াস। যেমন হেফাজতে ইসলাম একটা অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও তাদের আছে ভোট ব্যাংক। যার প্রভাব দেখেছি আমরা গাজীপুর, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময়।

গণজাগরণ মঞ্চের পেছনে সরকারি মদদ ছিলো বলে বিএনপি-জামায়াত বিশ্বাস করে। আর তাই তাদের সমর্থন ছিলো শাপলা চত্বরের সমাবেশে। জাতীয় পার্টিও সমর্থন দিয়েছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কৌশলে পরাজিত হয় এই প্রয়াস। তবে ক্রমেই সরকার কাছে টেনে নেয় হেফাজতকে। তাদের দাবির মুখে পরিবর্তন আসে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে। সবশেষ মহামান্য হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত একটি ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে তা অপসারণের আলটিমেটাম দেয়। আর এতে সমর্থন দেয় আশ্চর্যজনকভাবে সব দলই, ব্যতিক্রম শুধু বামদল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।

রাতের আঁধারে শুরু হয় এই ভাস্কর্য অপসারণ প্রক্রিয়া ভাষ্কর মৃণাল হকের চোখের জলের সামনে। রাতেই একদল তরুণ যুবা প্রতিবাদ জানাতে জড়ো হয় হাইকোর্টের সামনে। সকালে ঢাকা বিস্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয় বাম সংগঠন গুলো। এই অল্প কয়েকজন সাহসী তরুণ তরুণীদের যেভাবে এই তপ্ত আবহাওয়ার মধ্যে গরম জলে ভিজিয়ে দেয়া হয়েছে সেটা নির্লজ্জ বলতেও লজ্জা পাচ্ছি। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দীকে গ্রেপ্তার করা হয় সাথে আরো দুজন, যাদের একজনের গাঁয়ে জামা ছিলো না। উল্লেখ্য এই লিটন নন্দী গত বছর পহেলা বৈশাখে একদল পশুর হাত থেকে নির্যাতনের শিকার একটি মেয়েকে রক্ষা করেতে গিয়ে নিজে আহত হয়েছেন।

রাতের অন্ধকারেই আবার সেই ভাস্কর্য পুণঃস্থাপিত হয়েছে, একটু ভেতরে। এখন হেফাজত বলছে তারা প্রতারিত হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বলছেন এটাও এক ধরনের পরাজয়, যা তারা মানেন না। সরকার দায় নিচ্ছেন না এটা আদালতের এখতিয়ার বলে। বিএনপি কৃতিত্ব দিচ্ছেন প্রধান বিচারপতিকে, পাছে প্রধানমন্ত্রী না আবার রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেন।

আমার একটা আশঙ্কা হচ্ছে এই যে, হেফাজতকে যেভাবে গুরুত্ব্য দেয়া হচ্ছে, যেভাবে সব দল (বিশেষ করে প্রধান দলগুলো) এক কাতারে এসে দাঁড়াচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তারা একত্রে একাকার হয়ে যেতে পারে। আর পাল্টাপাল্টি ধারায় আরেকটি ফ্রন্ট প্রয়োজন হয়ে পরবে তখন। আমরা কি তারই মহড়া দেখছি? আমরা ভুলে যাচ্ছি এখন দেশের সিংহভাগ নাগরিক বয়সে তরুণ। তারা অনলাইনে, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, যুক্তিতে ঋদ্ধ। যেনতেন ভাবে তাদের আকৃষ্ট করা সম্ভব? একজন শেখ মুজিবের অপেক্ষায়...

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :