সংসদের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ পদ্ধতি বিশ্বে ব্যর্থ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২৮ মে ২০১৭, ২১:২১
ফাইল ছবি

সংসদের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ পদ্ধতি বিশ্বের যেসব দেশে রয়েছে, সেখানে নানা ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এটি সফল হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দিয়ে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের ওপর শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে এই কথা জানান তিনি।

আজ রবিবার ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম তার বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করে সাংবাদিকদের কাছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

আজ রবিবার অষ্টম দিনের মতো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামীকাল সোমবার আবার এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন রয়েছে।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি চলছে। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

ব্যারিস্টার আমীর বলেন, ‘আমাদের আশপাশের যেসব দেশ রয়েছে, বিশেষ করে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াতে সংসদের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ পদ্ধতি সফল হয়নি। এসব দেশের দৃষ্টান্ত আমি আদালতে তুলে ধরেছি।’

নির্বাচনী বিরোধ নিয়ে যেসব মামলা হয়, সেগুলোর শুনানি ও নিষ্পত্তি হাইকোর্টে হয় উল্লেখ করে ব্যারিস্টার আমীর বলেন, ‘এসব মামলার নিষ্পত্তি করেন বিচারকরা। এখন বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি যদি সংসদের হাতে থাকে তাহলে ভারসাম্য নষ্ট করবে এবং বৈপরীত্য সৃষ্টি করবে।’

আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার যে ভূমিকা, তিনটি সামরিক শাসনের কবল থেকে আমাদের বাঁচিয়েছেন, সংবিধান রক্ষা ও পুনরুদ্ধার করেছেন। সংসদ ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্য স্বাধীন বিচারব্যবস্থার বিকল্প নেই।’

ইয়াজউদ্দীন ও ফখরুদ্দিনের অসাংবিধানিক সরকার থেকে ফিরে আসতে হাইকোর্টের বিচারপতিদের ভূমিকা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘ওই সরকার হাইকোর্টকে জামিন না দিতে জরুরি ক্ষমতা বিধিমালা জারি করে। তিনজন বিশিষ্ট নাগরিক (সুলতানা কামাল, নুরুল কবির ও মুনতাসীর মামুন) ওই বিধিমালা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। আমি তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করি। হাইকোর্ট ওই বিধিমালা বাতিল ঘোষণা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।’

‘আমরা ঘরে ফিরে যেতে চাই’, অ্যাটর্নি জেনারেলের এমন বক্তব্যের জবাবে ব্যারিস্টার আমীর বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দিয়ে ঘরে ফিরিয়েছেন। ঘরে ফেরাতে গিয়ে তারা যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সাহস করে করেছিল, সেই স্বাধীনতা যাতে অক্ষুণ্ন থাকে সে জন্য এটি সংসদের হাতে না রেখে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছেই থাকুক। ওই রায়েই বলা হয়েছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অনেক বেশি স্বচ্ছ ও কার্যকর। ঘরে ফেরার ব্যাপারে আপিল বিভাগ তার রায় দিয়ে সাহায্য করেছেন।’

সংবিধানের ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি সংক্রান্ত সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম আমীর-উল ইসলাম বলেন, এই অনুচ্ছেদে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ও ২৬ মার্চ-এ জাতির পিতার ভাষণ এবং ওই বছরের ১০ এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে ওই সময়কালের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি বলে গণ্য করা হয়েছে। অথচ এগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল।

‘অস্থায়ী’ শব্দটি ব্যবহারে আপত্তি জানিয়ে ব্যারিস্টার আমীর বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তো অমরত্ব লাভ করেছে। আর এটা মুজিবনগর সরকারই বা কেন বলা হবে, এটা তো বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এগুলো কি সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এটা কি সংবিধানের ভাষা হলো? এ কারণেই সংবিধান পড়তে আমার কষ্ট হয়। যাদের সংবিধান সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, তারাই সংবিধান কাটাছেঁড়া করে এ সমস্ত ভাষা ব্যবহার করেছে এবং সংশোধনী এনেছে।’

তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র ও সংবিধানের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে সুপ্রিম কোর্ট সব সময় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন সামরিক শাসন আমলে সংবিধানকে যেভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে। এই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের ও জাতির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

সংবিধানের অভিভাবক, গণতন্ত্র ও আইনের শাসকের রক্ষক এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিফলন হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট কাজ করে চলেছে বলে মন্তব্য করেন এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘সেই কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার ও সংসদ সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবেন এটাই প্রত্যাশা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিচার বিভাগ, নির্বাহী ও আইন বিভাগ একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করে থাকে। আমাদের দেশেও ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।’

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ভারসাম্যপূর্ণ একটি পদ্ধতি বলে উল্লেখ করে এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটা যেভাবে চলে আসছে এবং তার যে অর্জন ও সফলতা, সেটা দেশবাসী গৌরবের চোখে দেখে। এই গৌরবকেই আমাদের সমুন্নত রাখতে হবে।’

গত ৮ মে পেপার বুক থেকে রায় পড়ার মাধ্যমে এই মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়। এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, রিটকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এবং অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে রোকন উদ্দিন মাহমুদ, টি এইচ খান ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ব্যারিস্টার আমীরের পর অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য দেন। এ আপিল মামলায় মোট ১২ জন অ্যামিকাস কিউরি মনোনীত করেছে আদালত।

১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করা হয়।

বিলটি পাসের পর গত ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ পায়। দেশের শীর্ষ আইনজীবীরা এবং সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলো এ সংশোধনী প্রত্যাখ্যান করে। পরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।

আবেদনে বলা হয়, এই সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্যতম অংশ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের ডিভিশন বেঞ্চ ওই সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করেন। পরে এই রুল শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজা-উল হককে এই বিশেষ বেঞ্চে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এ মামলার রুল শুনানিতে দেশের শীর্ষ ৫ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি অ্যামিকাসকিউরি হিসেবে অভিমত নেন আদালত। শুনানি শেষে আদালত ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ, যার শুনানি চলছে এখন।

(ঢাকাটাইমস/২৮মে/এমএবি/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আদালত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আদালত এর সর্বশেষ

ব্যবসায়ী নাসিরের মামলা: পরীমনিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি

বোট ক্লাব কাণ্ড: পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন

সেই রাতে ৮৭ হাজার টাকার মদ খেয়েছিলেন পরীমনি, পার্সেল না দেওয়ায় তাণ্ডব

বোট ক্লাব কাণ্ড: প্রতিবেদন দিল পিবিআই, ব্যবসায়ী নাসিরের মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন পরীমনি?

ড. ইউনূসকে স্থায়ী জামিন দেননি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল

সদরঘাটে লঞ্চ দুর্ঘটনা: আসামিদের তিনদিনের রিমান্ড

অরিত্রীর আত্মহত্যা: চতুর্থ বারের মতো পেছাল রায় ঘোষণার দিন, কী কারণ?

অরিত্রীর আত্মহত্যা: ভিকারুননিসার ২ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলার রায় আজ

বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বিকে হলের সিট ফেরত দেওয়ার নির্দেশ

আত্মসমর্পণের পর ট্রান্সকমের ৩ কর্মকর্তার জামিন

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :