সংবিধান জগাখিচুড়ি হয়ে যাচ্ছে: আপিল বিভাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ৩০ মে ২০১৭, ২০:৩৮

ইচ্ছামতো সংশোধনী আনায় সংবিধান জগাখিচুড়ি হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আপিল বিভাগ। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণসংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানিতে আপিল বিভাগ এ মন্তব্য করে।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এ শুনানি চলছে। আজ মঙ্গলবার দশম দিনের শুনানি শেষ হয়েছে। পরবর্তী শুনানি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। ওই দিনই এ মামলার শুনানি শেষ হবে বলে জানান আদালত। এদিন অ্যাটর্নি জেনারেলকে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে।

এ মামলার শুনানিতে আদালতকে আইনি সহায়তা করতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর মধ্যে ১০ জন তাদের মতামত উপস্থাপন করেছেন। আজ মতামত দেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল।

অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হওয়ার পর সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইন্টারভেনার হিসেবে বক্তব্য দেন।

অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে আজ প্রথম বক্তব্য দেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি। তিনি ১৬তম সংশোধনীর পক্ষে মত দিয়ে বলেন, বিচারকরা জনগণের হয়ে বিচারকাজ করছেন। তাদের জবাবদিহির প্রয়োজন আছে। এই জবাবদিহি করতে হবে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের কাছে। কারণ সংবিধান অনুযায়ী ‘সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। এই জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। ফলে ষোড়শ সংশোধনী ওই জায়গাতেই নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সংসদের কাছে জবাবদিহি থাকবে। ১৬তম সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর ওপর আঘাত করে না।

তার বক্তব্যের একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের থাকার জায়গা নেই। এই সুপ্রিম কোর্টের একটি প্রশাসনিক ভবন নেই। সুপ্রিম কোর্টের অনেক কর্মকর্তার বসার কক্ষ নেই। অথচ দেশের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। তিনি বলেন, ‘আমি হাজারটা উদাহরণ দিতে পারি যে, আমাদের বিচার বিভাগ বিচারের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলা গোটা দুনিয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। দেশের মানুষ ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করল। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপেই ওই মামলার জট খুলে গেল। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তরিত হয়েছে। এই শহর দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেল। গুলশান ও বারিধারা লেক এবং শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপেই রক্ষা পেয়েছে।’

বিচার বিভাগের স্বার্থে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচারকরা বিচার করেন উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘দেশের জনগণের স্বার্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সব সময় পদক্ষেপ নিয়েছে বিচার বিভাগ। জনগণের স্বার্থ জড়িত থাকলে সেখানে যতই ক্ষমতাশালী থাকুক না কেন, সেখানে বিচারকরা বিচার করতে ভয় পায় না।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর সংবিধান করা হয়েছে। পরবর্তীতে এই সংবিধান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ইচ্ছামতো সংশোধন করা হচ্ছে। জগাখিচুড়ি হয়ে যাচ্ছে।’

এরপর সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী তার বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। তিনি ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রয়েছে। এটার কারণে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। এটা থাকার কারণে ইচ্ছা থাকার পরও স্বাধীনভাবে নিজ দলের বিরুদ্ধে মতামত দিতে পারেন না কেউ। এ ক্ষেত্রে কি জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে? হবে না। বিচারক অপসারণের বিষয়েও সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন না। ফলে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না।

১৬তম সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দিয়ে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এত বড় বিষয় যে সংশোধনীর মাধ্যমে তা পরিবর্তন করা যায় না। আদালতের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের নিয়ে করা মন্তব্য আপনারা বাদ দিতে পারেন।’

এরপর আরেক সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার ফিদা এম কামালও ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে এটা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এই সুপ্রিম কোর্টই রায় দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে রেখে দিয়েছে। এ ব্যবস্থাকে আদালত স্বচ্ছ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ অবস্থায় ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল করতে পারে না। তিনি বলেন, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিবর্তন আনা হলো। ৯৬ অনুচ্ছেদেও পরিবর্তন আনা হলো। বিভিন্ন সময়ে ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

তার শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন আছে। সেখানে একটি সিলেবাস আছে। তাতে বলা আছে, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা যাবে। এর বাইরে গিয়ে প্রশ্ন করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। কমিশনের চেয়ারম্যানকে বিদেশ যেতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। হাত-পা এমনভাবে বেঁধে রেখেছেন যে..., আপনি বুঝছেন তো।’

এ সময় ফিদা এম কামাল বলেন, হাত-পা বেঁধে রাখলে তো সাঁতার কাটা যাবে না।

অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হলে আদালতে উপস্থিত সাবেক আইনমন্ত্রী ও সরকারদলীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইন্টারভেনার হিসেবে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। কিন্তু সংবিধানের সংশোধনীর প্রয়োজন হলে সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব কে করবে। তাদের পক্ষে সংসদ সদস্যরাই প্রতিনিধিত্ব করবেন। কারণ তারাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যরাই জনগণের প্রতিনিধি।

এ সময় প্রধান বিচারপতি তাকে ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং সর্বশেষ সংশোধিত সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করতে বলেন। মতিন খসরু উভয় প্রস্তাবনা পড়ার পর তিনি বলেন, ৭২ সালের আদি সংবিধানে ফিরে যেতেই এ (১৬তম) সংশোধনী আনা হয়েছে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। আদি সংবিধানে হাত দেওয়া যাবে না। পরিবর্তন করা যাবে না।

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন। হাত দেওয়া যাবে না বলছেন। তাহলে ১১৬ অনুচ্ছেদ কেন পরিবর্তন করলেন। এটার কি দরকার ছিল? নিম্ন আদালতে দ্বৈত শাসন চলছে। তাহলে আইনের শাসন কোথায়? প্রস্তাবনা কেন পরিবর্তন করলেন। এখানে কেন হাত দিলেন। আপনারা কত দূর যেতে পারবেন? সেটাও তো সংবিধানে বলা আছে। সংবিধানে কি পুনঃস্থাপনের কথা বলা আছে? আদি সংবিধানের ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদ দেখুন। সেখানে প্রতিস্থাপনের কথা আছে। রাজনৈতিক দল ৫ বছরের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসার পর ইচ্ছামতো সংবিধান সংশোধন করেছে। আপনি ৭২-এর সংবিধানের প্রস্তাবনা পড়েন আর এখনকার প্রস্তাবনা পড়েন। মিল নেই। দেখবেন, বিভিন্ন সময়ে সংবিধানের পরিবর্তন করতে করতে মূল বৈশিষ্ট্যই তো পরিবর্তন হয়ে গেছে। অনেক বিচ্যুতি (ডেভিয়েশন) ঘটিয়েছেন।

এ সময় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, ‘আমরা তো জানি যে প্রায় দেড় বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে। সব পক্ষের মতামত নিয়েই এটা করা হয়েছে। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিতে বলেছেন যে তড়িঘড়ি করে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, জাতীয় সংসদ বুঝেশুনেই এ সংশোধনী এনেছে।’ তিনি বলেন, ‘রিট আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী ১৬তম সংশোধনী আনার আগে প্রেক্ষাপট হিসেবে দেশের কিছু ঘটনার কথা বলেছেন।

এ সময় আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘আমরা তো একটি মহৎ উদ্দেশ্যে এ সংশোধনী এনেছি। অসৎ উদ্দেশ্যে আনা হয়নি।’

বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, এ মামলা (১৬তম সংশোধনী চ্যালেঞ্জ) যখন হাইকোর্টে বিচারাধীন তখন তো তাড়াহুড়ো করে আইন করলেন।

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘একটি নির্বাচনে একটি দল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। পরের নির্বাচনে বা অন্য কোনো নির্বাচনে একটি দল সরকার গঠন করলেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। একটি ঝুলন্ত সংসদ হলো। ওই সময় একজন বিচারকের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ উঠল। তখন কী হবে? প্রধান বিচারপতি কী করবেন?’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘৪৫ বছর ধরে দেখছি। এখন এমন হয়েছে যে একজন দাওয়াত দিলে আরেকজন যান না। আপনাদের দাওয়াতে যদি আপনারা না যান?’

(ঢাকাটাইমস/৩০মে/এমএবি/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আদালত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আদালত এর সর্বশেষ

ব্যবসায়ী নাসিরের মামলা: পরীমনিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি

বোট ক্লাব কাণ্ড: পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন

সেই রাতে ৮৭ হাজার টাকার মদ খেয়েছিলেন পরীমনি, পার্সেল না দেওয়ায় তাণ্ডব

বোট ক্লাব কাণ্ড: প্রতিবেদন দিল পিবিআই, ব্যবসায়ী নাসিরের মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন পরীমনি?

ড. ইউনূসকে স্থায়ী জামিন দেননি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল

সদরঘাটে লঞ্চ দুর্ঘটনা: আসামিদের তিনদিনের রিমান্ড

অরিত্রীর আত্মহত্যা: চতুর্থ বারের মতো পেছাল রায় ঘোষণার দিন, কী কারণ?

অরিত্রীর আত্মহত্যা: ভিকারুননিসার ২ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলার রায় আজ

বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বিকে হলের সিট ফেরত দেওয়ার নির্দেশ

আত্মসমর্পণের পর ট্রান্সকমের ৩ কর্মকর্তার জামিন

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :