নির্বাচনের পথে
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) পারবে তো? পারবে তো রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিতে? সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসি কতটুকু সক্ষম? এই প্রশ্নগুলো যখন রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা আর চায়ের টেবিলে ঘুরছে তখন ইসি এলো রোডম্যাপ নিয়ে। যা পৌঁছে দেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুয়ারে।
রোডম্যাপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সব রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনের চেষ্টায় আছে নতুন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা তো স্পষ্টই বললেন, কোনো বিষয় চাপিয়ে না দিয়ে দলগুলোর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করবেন। আর মতামত নেওয়ার জন্যই ইসি সংলাপে বসবে দলগুলোর সঙ্গে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখনো প্রশ্ন তোলে বিএনপি। কিন্তু তাদের এই প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি কখনো। কারণ, গেল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের অংশ নিতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ডাকা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনও চেয়েছিল বিএনপি নির্বাচনে আসুক। শেষে গোঁ ধরে থাকা বিএনপি নিজেদের অবস্থান থেকে একচুল নড়েনি। তারা দাবি করেছিল নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অনেকটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো। তাদের ভয় ছিল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে তাদের ভরাডুবি হবে। তার চেয়ে নির্বাচন থেকে দূরে থেকে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। তবে আন্দোলনের কোনো ইতিবাচক ফল তারা ঘরে তুলতে পারেনি।
নতুন নির্বাচন কমিশন চায় না দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হোক। এটা কোনো গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনব্যবস্থার জন্য দৃষ্টিনন্দন হবে না। যে কারণে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে প্রস্তুত হয়েছে নুরুল হুদার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিশন। যদিও জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সিটি করপোরেশন, উপজেলা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি।দায়িত্ব নেওয়ার সাড়ে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়ে কিসের ইঙ্গিত দিল ইসি? এই প্রশ্নও শোনা যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের একটা প্রক্রিয়া। ইসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই বললেন, বিএনপি আগে কদিন আগে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে আপত্তি দিয়ে চিঠি লিখেছে। কমিশন তাদের চিঠিটি আমলে নিয়েছে বলেই ঘোষিত রোডম্যাপে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলেনি।
ইসির এই পদক্ষেপে বিএনপি অবশ্য সাময়িকভাবে স্বস্তি প্রকাশ করেছে। দলটি বলেছে, ইভিএম বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তে তারা সন্তুষ্ট। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সরকারি দল ইভিএমের পক্ষে ছিল। সেখানে ইসি নিজে থেকেই এটি বাদ দিয়েছে। এটি অবশ্য ভালো।’
আওয়ামী লীগ নেতারাও এ নিয়ে আপত্তি জানায়নি। বরং ইসির রোডম্যাপের ব্যাপারে তারা আশাবাদী বলে জানিয়েছে। দলের সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান বলেন, ‘ইভিএমে দ্রুত ভোট দেওয়া যায়। গণনাও সহজ হয়। এ জন্য ইভিএম আমরা চেয়েছিলাম। ইসি যদি মনে করে এটা ঠিক হবে না, তবে এটা তাদের বিষয়।’
ইভিএম নিয়ে স্বস্তি থাকলেও বিএনপি এখন তাকিয়ে আছে নির্বাচনকালীন ‘সহায়ক সরকারের’ দিকে। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তারা এখনো অটল। বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আপনারা যত রোডম্যাপ দেন, আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান, আমরা আলোচনা করতে রাজি আছি। কিন্তু নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হলে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে। নিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা আগে করতে হবে।’
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘নতুন কমিশন যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে আমি এতে খারাপ কিছু দেখি না। তারা ভালো কথা বলেছে। কোনো সিদ্ধান্ত তারা চাপিয়ে দেবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। এর চেয়ে আর কী ধরনের নিরপেক্ষতা প্রয়োজন?’
এই বিশ্লেষক বলেন, ‘বিএনপির যদি কোনো কথা থাকে তারা সংলাপে অংশ নিয়ে বলবে। ইসি যদি যৌক্তিক মনে করে অবশ্যই তাদের কথা রাখবে। শুধু ঢালাও অভিযোগ করলে তো হবে না। বিএনপিকে স্পষ্ট করে বলতে হবে। রাস্তাঘাটে বলে বেড়ালে হবে না। যারা শুনবে, যারা ব্যবস্থা নেবে, তাদের কাছে তুলে ধরতে হবে। আমি মনে করি না, বিএনপি গতবারের মতো এবারও মস্ত ভুল করবে।’
রোডম্যাপে যা আছে
রোডম্যাপের সাতটি বিষয়ের মধ্যে আছে- অর্থ ও পেশিশক্তির অবৈধ ব্যবহারমুক্ত এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা। এজন্য আইনি কাঠামোতে সংস্কার আনা হবে। ইসির প্রস্তাবিত আইনের সংশোধনীতে মত নেওয়া হবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মতামত দেবে। এই কাজগুলো আগামী জুলাইয়ে শুরু হবে। শেষ করা হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে। ভোটাররা যেন নিজের ভোট পছন্দের প্রার্থীকে দিতে পারেন, সে জন্য নির্বাচনি প্রক্রিয়া আরও সহজ ও যুগোপযোগী করা হবে। বিভিন্নভাবে ভাগ করে এই কাজগুলো এ বছরের মাঝামাঝিতে শুরু করে পরের বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে গুছিয়ে ফেলবে। থাকবে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনও। চাহিদা পূরণ করতে পারলে আসলে অক্টোবরে আবেদন করে নিবন্ধন নিতে পারবে নতুন রাজনৈতিক দল।
এসবের চেয়ে যে বিষয়টি আলোচনার তুঙ্গে তা সংলাপ। এটি নতুন কোনো উদ্যোগ নয়। অতীতেও বিভিন্ন সময় কমিশনের সঙ্গে বসেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে সংলাপ বরাবরই বেশ গুরুত্ব পায়। ইসি বলেছে, তারা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, নির্বাচন কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। আসছে জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে এটি শেষ করা হবে। এই সংলাপ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একবারই করবে ইসি।
এছাড়া ভোট কেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচন যারা পরিচালনা করবেন তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও আছে নতুন কর্মপরিকল্পনায়।
নির্বাচন কমিশনার ও সচিব যা বললেন
জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে কী পদক্ষেপ নেবেন এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনি রোডম্যাপে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসার বিষয়টিও রেখেছি। আমরা আগামী জুলাই থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করব। সেখানে তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হবে। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করব।’
বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কোনো বিশেষ পরিকল্পনা আছে কি না-জানতে চাইলে কবিতা খানম বলেন, ‘আশা করছি ওই আলোচনায় আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাব। আমার বিশ্বাস সব রাজনৈতিক দলকে নিয়েই আমরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে পারব।’
তবে নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে সবাই আসবে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘সবাই যদি মাঠে থাকে তাহলে কীভাবে নির্বাচনে অনিয়ম হয়? সবাই মাঠে থাকলে ইসি চাইলেও সবকিছু করতে পারবে না। আর যদি কেউ মাঠে না থাকে তাহলে যা হওয়ার তাই হবে।’
ইভিএম নিয়ে সিইসি যা বলেছেন
সিইসি নুরুল হুদা বলেন, ‘ইভিএম আগেও ছিল, মাঝখানে স্তিমিত হয়েছে। এখন নতুনভাবে তা কাজে লাগাতে আমরা কাজ করছি। এ প্রযুক্তির নানা দিক সবার কাছে উপস্থাপন করা হবে। সবার সায় পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেব। কোনো রাজনৈতিক দল আপত্তি করলে তা নিয়ে আমরা রিস্ক নেব না।’
চার কমিটিতে যারা
নির্বাচন সামনে রেখে কর্মযজ্ঞ গুছিয়ে নিতে চারটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি করা হয়েছে। ইসি সচিব ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের এ কমিটিতে রাখা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও পদোন্নতি; নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম সীমানা পুনর্নির্ধারণ; নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র ও স্মার্টকার্ড প্রস্তুতি এবং নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম আইন সংস্কার কমিটির প্রধান থাকবেন। ইসি সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাচিবিক দায়িত্বে থাকছেন।
ঢাকাটাইমস/৩১মে/এইচএফ/ডব্লিউবি
মন্তব্য করুন