উলিপুরের ক্ষীরমোহন
ক্ষীরমোহন। ভোজনের রসনায় কুড়িগ্রাম জেলার অনন্য এক মিষ্টান্নের নাম। এটি উলিপুরের আদি মিষ্টি না হলেও গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষ ও ষাটের দশকের শুরুতে তৈরি ও বিপণন শুরু হয় এখানে। ওই সময় এ অঞ্চলের মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা কম থাকায় তা কিনে খাওয়া সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে ছিল না।
তখন একটি ক্ষীরমোহনের দাম ছিল ছয় আনা। যে কারণে তখন রেস্টুরেন্ট ও বাড়ির টেবিলে এই মিষ্টান্নটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবে এর স্বাদ ও গন্ধ তখন থেকেই ছিল জিভে পানি আনার মতো।
আশির দশকে এসে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে।এখন এই মিষ্টির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরের বিভিন্ন দেশে।জানা যায়, ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ ও বঙ্গবন্ধু এই মিষ্টি খেয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
ক্ষীরমোহন তৈরির ইতিহাস
প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৫৮ সালে তৎকালীন ফরিদপুরের গোয়ালন্দ থেকে সুধীর সরকার ওরফে সুধীর ময়রা নামে এক ব্যক্তি উলিপুরে আসেন। তিনি মিষ্টির কারিগর হিসেবে চাকরি নেন কছির মিয়ার রেস্টুরেন্টে। চাকরির শর্ত ছিল, তিনি এমন মিষ্টি বানাবেন যা দিয়ে দোকানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। রাজি হন সুধীর ময়রা। তিনি চাকরির শুরুতে এই এলাকায় প্রথম ক্ষীরমোহন তৈরি করে বাজিমাত করে ফেলেন। তার দেখাদেখি উলিপুরের প্রখ্যাত মিষ্টান্নের কারিগর মনমোহন হালাই তৈরি করেন ক্ষীরমোহন।
ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতা (সাবেক সংসদ সদস্য) কানাই লাল সরকার এই মনমোহন হালাইয়ের কাছ থেকে তৈরি করে নেয়া ক্ষীরমোহন ও ‘শেখ মুজিব’ নামাঙ্কিত সন্দেশ উপহার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেই ক্ষীরমোহন খেয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
এ ছাড়া এই জেলা ও বিভাগে কোনো সরকারপ্রধান, মন্ত্রী ও বিদেশি অতিথি এলে তাদের ভোজনের অনুষঙ্গ হিসেবে দেয়া হয় ক্ষীরমোহন।
যে কারণে জনপ্রিয় ক্ষীরমোহন
নদীবেষ্টিত উলিপুরের চারদিকে ছিল প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা ঘাসসহ নানা গো-খাদ্য। বাড়িতে লালন-পালন করা গাভিকে তা খেতে দেয়া হতো। ওই সময় গরুর দুধ ছিল খাঁটি দুধের গুণাগুণ সমৃদ্ধ। সেই দুধ থেকে তৈরি ক্ষীরমোহন স্বাদে-গন্ধে ছিল অনন্য। এখনকার চেয়ে দেখতে একটু লম্বাটে এই মিষ্টি ক্ষীর প্লেটে করে টেবিলে উপস্থাপনের আগেই ‘ঘ্রাণে অর্ধ ভোজনম’ হয়ে যেত। এখন দেশে উলিপুর শব্দ উচ্চারিত হলে তার সঙ্গে উচ্চারিত হয় অসাধারণ এই মিষ্টির নাম ‘উলিপুরের ক্ষীরমোহন।’
যেভাবে তৈরি হয়
খাঁটি ছানা থেকে তৈরি মিষ্টি প্রথমে গরম চিনির রসে জ্বাল দেয়া হয়। মিষ্টিপ্রায় হয়ে এলে তা থেকে রস ঝরিয়ে নিয়ে দুধে জ্বাল দেয়া হয়।দুধ ক্ষীরে পরিণত হলে ও মিষ্টির ভিতরে ক্ষীর ঢুকে গেলে তৈরি হয় লোভনীয় ‘ক্ষীরমোহন’।
সাইজে আগের চেয়ে একটু ছোট হলেও এর স্বাদ নিতে চায় ছোট-বড় সবাই।
দাম
এখন প্রতিটি ক্ষীরমোহন দোকানভেদে ২০-২৫ টাকা ও প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকায়।
তথ্যসূত্র: দিজেন দেব নারু, শিশির মজুমদার, অমরেন্দ্র নাথ সরকার, মাহমুদুর রহমান বেটু ও গোবিন্দ ঘোষ।
(ঢাকাটাইমস/১জুন/পিএম/ডব্লিউবি)