সন্তানের ব্যক্তিত্ব বিকাশে মা-বাবার করণীয়

মল্লিকা দে
| আপডেট : ০১ জুন ২০১৭, ১২:২৮ | প্রকাশিত : ০১ জুন ২০১৭, ১২:০১

ব্যক্তিত্ব বা পারসোনালিটি বলতে বোঝায় ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, অনুভূতি ও আচরণের ধরণকে। আর এই ব্যক্তিত্ব একেকজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক রকম। সাইকোএনালাইসিসের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, আমাদের ব্যক্তিত্ব তিনটি মানসিক কাঠামোর সমন্বয়ে গঠিত। ইড(ID), ইগো(Ego) এবং সুপারইগো(Superego)। তিনি আরও বলেছেন, একটি শিশুর জন্ম থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যেই এই তিনটি কাঠামো তৈরি হয়ে যায়।

তবে অনেকেই আবার তার সাথে একমত হতে পারেননি। কিন্তু একথা স্পষ্ট যে, ব্যক্তিত্বের বিকাশ একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও, এর গঠনে ছোটবেলার শিক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছোটবেলায় আমরা আমাদের বাবা-মা, পরিবার ও পরিবেশ থেকে যা কিছু শিখি, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের মনে রেখাপাত করে। এই শিক্ষণগুলোই আমরা পরবর্তী জীবনে চর্চা করি এবং এগুলো আমাদের ব্যক্তিত্বে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে।

তাই সন্তানের ব্যক্তিত্ব বিকাশে শিশুকালে (১ থেকে ৯/১০ বছর বা বয়সন্ধির আগে পর্যন্ত) বাবা-মায়ের করণীয় কি, সে সম্পর্কিত কিছু নির্দেশনা নিচে উল্লেখ করা হল:

১) মনে রাখুন আপনার শিশুর মত আর কেউ নেই। আপনার শিশু অদ্বিতীয় মানসিকতার অধিকারী।

২) আপনার শিশুকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করুন। খেলাধুলা শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। খেলাধুলায় শিশুর শারীরিক, মানসিক এবং আবেগীয় বিকাশ ঘটে। শিশু শেখে, কীভাবে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সমস্যার সমাধান করতে হয়, নেতৃত্ব দিতে হয় ইত্যাদি। এছাড়া খেলাধুলা শিশুর কল্পনার জগৎকেও বিকশিত করে।

৩) ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে শিশুকে সহযোগিতা করুন। সঠিক শব্দ ও ভাল ভাষা ব্যবহারে তাকে উৎসাহিত করুন এবং খারাপ ভাষা পরিহার করতে বলুন।

৪) শিশুকে শ্রেণিবদ্ধ করা পরিহার করুন। যেমন-আমার ছেলেটা খুব লাজুক বা আবেগী। নিজের মতামত দ্বারা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত না করাই ভাল।

৫) আপনার শিশুকে নিয়মানুবর্তিতা শেখান। আপনি তার কাছ থেকে কী ধরনের আচরণ আশা করেন তা ব্যাখ্যা করুন।

৬) আপনার শিশু যখন প্রত্যাশিত আচরণ করবে তখন তাকে পুরস্কার দিন। পুরস্কার হিসেবে আপনি তাকে তার কোন পছন্দের জিনিস কিনে দিতে পারেন। আবার মৌখিক পুরস্কারও দিতে পারেন। যেমন-তুমি খুব ভাল মেয়ে, তোমাকে খুব ভালবাসি ইত্যাদি।

৭) যখন আপনি আপনার শিশুকে কোন কিছু করার জন্য ‘না’ বলছেন, তখন তার কারণ ব্যাখ্যা করুন। যেমন-‘কখনো মিথ্যা কথা বলবে না’। এক্ষেত্রে মিথ্যা না বলার কারণগুলো তাকে ব্যাখ্যা করুন এবং এর পরিবর্তে সে কী করবে তাও তাকে বলুন।

৮) যখন আপনার শিশু কোন বিষয় নিয়ে হতাশ থাকে, তখন তাকে ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করুন।

৯) অপরিচিত মানুষদের মাঝেও নিজেকে কীভাবে নিরাপদ রাখতে হয় তা শেখান।

১০) শিশুকে পরিবার ও স্কুলের নিয়মকানুনগুলো মেনে চলতে শেখান। হয়ত শিশু বুঝতে পারছে না কেন তাকে এই নিয়মগুলো মানতে হবে, তখন তাকে নিয়মকানুনের গুরুত্ব বুঝিয়ে বলুন। এতে করে পরবর্তী জীবনে সে সমাজের আইন কানুনগুলোর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবে।

১১) একটি শিশুর ব্যক্তিগত মুল্যবোধনির্ভর করে তার আশেপাশের মানুষের বিচারের উপর। তাই আপনার শিশুর সামনে ঝগড়া করা বা অন্যকে অসন্মান করে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন।

১২) শিশুকে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে শ্রদ্ধা করতে শেখান। নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে সেটা চর্চা করুন। কারন, আপনিই হয়তো আপনার শিশুর অনুসরনীয় ব্যক্তি।

১৩) শিশুকে কোন কিছু নিয়েই ভয় দেখাবেন না। বরং আপনার শিশু কোন সমস্যায় পড়লে, সমস্যা সমাধানে তার সহযোগী হোন।

১৪) পারিবারিক কোন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আপনার শিশুকেও সংযুক্ত করুন। এতে করে তার ভিতর দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে।

১৫) আপনার শিশুর সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তার স্কুলের ছোট ছোট গল্প, বন্ধুদের গল্প, তার চিন্তার জগৎ, তার আগ্রহের বিষয় জানতে আগ্রহী হোন।

১৬) পারিবারিকভাবে নৈতিকতার চর্চা করুন এবং শিশুকে নৈতিকতার শিক্ষা ও সৎ থাকার পরামর্শ দিন।

১৭) শিশুর যেকোন ধরনের অন্যায়কেই নিরুৎসাহিত করুন। সবসময় শাস্তি দিয়েই যে অন্যায় বন্ধ করা যায় এমন নয়। অনেক সময় বুঝিয়েও বলা যেতে পারে। ছোটবেলা থেকেই অন্যায়কে নিরুৎসাহিত করলে বড় হয়ে অন্যায় করার সম্ভবনা কমে যায়।

১৮) শিশুকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত করুন। এতে তার ভিতর উদার মানসিকতার বিকাশ হবে।

বর্তমান সময়ে দিনে দিনে যৌথ পরিবারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আবার বাবা-মা দুজনই চাকরি করার সুবাদে হয়তো সন্তানকে খুব বেশি সময় দিতে পারছেন না। এ কারণে পারিবারিক বন্ধন ও সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের মানসিক যোগাযোগও কমে যাচ্ছে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, সন্তানের ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ, আদর্শ গঠনে বাবা-মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। তাই সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তাকে পর্যাপ্ত সময় দিন, তাকে আপনি কতটা ভালবাসেন এবং তাকে নিয়ে যে আপনি চিন্তা করেন এটা তাকে বুঝতে দিন। সন্তানের চলার পথে তার বন্ধু হোন। আপনার দেয়া শিক্ষাই হয়তো পরবর্তী জীবনে আপনার সন্তানকে জঙ্গিবাদ, মাদকাসক্ততা, ধর্ষণ, চুরি ও অন্যান্য ব্যক্তিত্বের অবক্ষয়মূলক অপরাধকর্ম থেকে দূরে রাখবে।

লেখক: প্রভাষক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ

আই ইউ বি এ টি ইউনিভার্সিটি, উত্তরা, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :