সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় যে কোনো দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০১ জুন ২০১৭, ১৭:৫৩ | প্রকাশিত : ০১ জুন ২০১৭, ১৩:৩৪

বিচারকদের অপসারণক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে আনা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিলের বিরুদ্ধে আপিলের রায় ঘোষণা হবে যে কোনো দিন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ সাত বিচারপতি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শেষে এই সিদ্ধান্ত জানায় আপিল বিভাগ।

বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১টার দিকে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ আপিল বিভাগ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।

বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি অপসারণের ব্যবস্থা করে। বর্তমান সরকার আবার আগের পদ্ধতি ফিরিয়ে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করে। কিন্তু হাইকোর্টে এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পর আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

এই আপিল শুনানিতে আদালত বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করে। এদের বেশিরভাগই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে আনার ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন।

শুনানির শেষ দিন রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিটকারীদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

অ্যাটর্নি জেনারেল ষোড়শ সংশোধনী বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদসমূহ বলতে, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের গণপরিষদে যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল সেই অনুচ্ছেদসমূহকেই বুঝাবে। সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদসমূহ ভাল বা মন্দ বা তাতে মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতটা রক্ষিত হয়েছে বা হয়নি সে কথা বলার এখতিয়ার বিচার বিভাগের নেই। কারণ বিচার বিভাগ সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট। সৃষ্টি তার স্রষ্ট্রার ভাল-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা রাখে না। সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদসমূহ সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কেবলমাত্র যখন তা সংশোধন হয় তখন সে সংশোধন সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কি না তা বিচার করার এখতিয়ার উচ্চ আদালতের আছে।’

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিচারপতিদের অপসারণ বিষয়ে কী পদ্ধতি গৃহীত হবে তা একটি নীতি-নির্ধারণী বিষয়। এই নীতিনির্ধারণের বিষয়টি আদালতের বিচার্য বিষয় হতে পারে না।’

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে আছি। আপনি যদি অধঃস্তন আদালত বিষয়ক আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি তো আইন প্রণেতা নই।’ তিনি বলেন, ৯৬ (৩) এ বলা নেই যে, ‘বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদ তদন্ত করবে। ষোড়শ সংশোধনীর ফলে প্রতিস্থাপিত অনুচ্ছেদ ৯৬ (৩) এর পরিপ্রেক্ষিতে যে আইন প্রণীত হবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই আইনের বিধান বিবেচনা করে বোঝা যাবে যে, অপসারণের বিধান তদন্তের বিষয়ে কোন ব্যক্তিদের সংযুক্ত করা হবে, তদন্ত নিরপেক্ষ হবে কি না বা সে আইনের দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে কি না। কাজেই ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত ৯৬ (২) এবং ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের পরিপন্থী কিনা তা বিচার করার অবকাশ নেই।’

মাহবুবে আলম বলেন, ‘বিচার বিভাগ সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ। নিজেদের বিচার নিজেরা করাটা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। এ পদ্ধতিতে প্রধান বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। অন্যান্য বিচারপতিদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। বিচারপতিরা যেহেতু একসাথে বহুদিন কাজ করছেন, একে অপরের পরিচিত সেহেতু তাদের অসদাচরণ ও অসমতা বিচারের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের পক্ষে তাদের আবেগ অনুভূতির ঊর্ধ্বে ওটা সম্ভব নাও হতে পারে।’

এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের তদন্তে বিএমডিসির ব্যর্থতার উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, ‘কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার জন্য কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বা শর্ত ভঙ্গের কারণে আজ পর্যন্ত এমন নজির নেই। তাই আইন করার আগে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা সমীচিন হবে না।’

বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা বলেন, ‘ক্ষমতা যদি নিয়ে যান তাহলে জাজদের কে তদারকি করবে। কোনো বিচারপতিই প্রধান বিচারপতির অধীন না। তারা স্বাধীন। কেউ মানবে না।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কয়দিন আগে ভারতে কি হয়েছে? হাইকোর্টের একজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে। কারণ ওই বিচারক জানে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির নেই।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনারা কেন এত শঙ্কাবোধ করছেন?’

বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া বলেন, ‘১২টায় বেঞ্চে বসবে, দুই তিন বছর পর রায় লিখবেন তখন বুড়ো আঙুল দেখাবে। তখন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ গঠন ছাড়া কিছু করতে পারবেন না।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মার্শাল ল প্রক্লেমেশন দ্বারা যেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানর করা হয়েছে। তা যদি রাখা হয় তা হবে ইতিহাসের বিরাট ভুল। ইতিহাস যেমন বিচারপতি মুনিমের কথা বলে তেমনি আপনাদের কথাও বলবে। আপনারা কেন সংসদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না?’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এ ধরণের বক্তব্য দেওয়া ঠিক না।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনারা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে আমার কাছে এটাই মনে হচ্ছে।’

এই পর্যায়ে বিচারপতি ইমান আলী বলেন, ‘মার্শল ল যদি বাদ দেন তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন। তাহলে তো চতুর্থ সংশোধনীতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে তাই নয় কি?’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘কেন চতুর্থ সংশোধনী কেন, আমরা তো আদি সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদেই যাব।’

মুরাদ রেজার যুক্তিতর্ক

এর আগে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, ‘জাতীয় সংসদের ওপর কেন এত অবিশ্বাস?...সামরিক শাসনের কারণে একটি কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তখন আমরা সুপ্রিম কোর্টের কোনো সাহায্য পাইনি। একজন প্রধান বিচারপতি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। সেই কালো অধ্যায়ের সময়ের করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা সুপ্রিম কোর্ট রেখে দিল।’

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই মার্শাল ল-এর অধীনে ফিরে যেতে চাই না।’

তখন মুরাদ রেজা বলেন, ‘তখন তো বিচার বিভাগের কেউ সাহস করে বলেনি কেন জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে বলবো না?’।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছি।

মুরাদ রেজা বলেন, ‘কিন্তু এই মামলায় হাই কোর্ট তো বলেছে আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্ট সবসময়ই সংবিধানের সঙ্গে ছিল। যখনই কোনো অবৈধ হস্তক্ষেপ হয়েছে আপনারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৯৬ অনুচ্ছেদে আপনারা মার্জনা করেছেন। বৈধ হলে কি সেটা মার্জনা করার প্রয়োজন ছিল? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অবৈধ ছিল বলেই আপনারা মার্জনা করেছেন। ওই সংশোধনী যদি মৌলিক কাঠামোর অংশ হতো তাহলে মার্জনা করার প্রয়োজন হতো না।’

মুরাদ রেজা বলেন, সংসদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আপনাদের আরও বেশি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। সংসদকে চ্যালেঞ্জ বা অপমান করার ক্ষমতা কারো নেই। বিচার বিভাগেরও নেই। সংসদকে অপমান করবেন না।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কে অপমান করেছে বলুন।’

তখন মুরাদ রেজা আদালতে মতামত দেওয়া অ্যামিকাস কিউরিদের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘একজন বাদে সবাই। তারা তো আদালতের বন্ধু। তাদের আলোচনা হওয়ার দরকার ছিল সাবজেক্টটিভ, অবজেক্টটিভ না। তারা উন্নত মানের অ্যাডভাইস দিলে আপনারা উন্নত মানের রায় দিতে পারতেন।’

বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা বলেন, ‘অ্যামিকাস কিউরিরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি এটা বলা ঠিক না। তারা ভুল না ঠিক বলেছে সেটা আমরা দেখব।’

রিটকারী আইনজীবীর যুক্তিতর্ক

এরপর আইনজীবী মনজিল মরসেদ তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টকে কিছু অভিমত নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছিল। কিন্তু ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো রিভিউ আবেদন করেনি। শর্তসাপেক্ষে মার্জনা করেছে বলে রাষ্ট্রপক্ষ যা বলছে তা সঠিক না। রাষ্ট্রপক্ষ জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিয়ে রিভিউই করেনি।

মসজিল মরসেদ বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান এটি ১৬ কোটি জনগণ না হলেও ১০ কোটি লোক এর পক্ষে আছে।’

(ঢাকাটাইমস/০১ জুন/এমএবি/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আদালত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আদালত এর সর্বশেষ

শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি

আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি

কক্সবাজারে কতজন রোহিঙ্গা ভোটার, তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট

সাউথ এশিয়ান ল' ইয়ার্স ফোরাম ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল চ্যাপ্টারের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন

আদেশ প্রতিপালন না হওয়ায় চট্টগ্রামের ডিসি এসপিসহ চার জনকে হাইকোর্টে তলব

১১ মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের শুনানি ২৯ জুলাই

২৮ দিন পর খুলল সুপ্রিম কোর্ট

ব্যবসায়ী নাসিরের মামলা: পরীমনিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি

বোট ক্লাব কাণ্ড: পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন

সেই রাতে ৮৭ হাজার টাকার মদ খেয়েছিলেন পরীমনি, পার্সেল না দেওয়ায় তাণ্ডব

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :