‘শুয়োরের বাচ্চাদের’ অর্থনীতি

কাওসার শাকিল
 | প্রকাশিত : ০৪ জুন ২০১৭, ১১:৩৬

শিরনাম দেখে ঘাবড়াবেন না। কাউকে গালি দেয়ার নিয়তে এ লেখা লিখছি না। ড. আকবর আলি খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ের একটা প্রবন্ধের নাম ওটা। সেই প্রবন্ধে তিনি বৃটিশ আমলের আসানসোলের মহকুমা প্রশাসক মাইকেল ক্যারিটের কথা লিখেছেন। মাইকেল ক্যারিট তার সাথে এক পাঞ্জাবী ঠিকাদারের কথোপকথনের বর্ননা করেছেন এভাবে- সেই পাঞ্জাবি ঠিকাদার বলেছিল ‘হুজুর এদেশে তিন ধরনের মানুষ আছে। যারা ঘুষ খায় না। যারা ঘুষ খায় এবং কাজ করে। আর তিন নম্বর দলে আছে কিছু শুয়োরের বাচ্চা, যারা ঘুষও খায় কিন্তু কাজ করে দেয় না।’ ‘শুয়োরের বাচ্চাদের’ অর্থনীতি হলো এটাই। মানে টাকা নিয়েও কাজ না করার অর্থনীতি।

অর্থনীতি জটিল এক শাস্ত্র। একে আমাদের দৈনন্দিন জ্ঞান মানে যাকে বলে কমনসেন্স, সেটা দিয়ে ব্যাখা করতে যাওয়াটা বোকামি। কেন না ব্যাপারটা তার থেকে আরেকটু বেশি জটিল। এর একটা বড় উদাহরণ হলো বাজেট। আমরা বাজেট বুঝি না, তবে টের পাই। ফলওয়ালা বাজেটের পরদিনই আপেলের দাম ১৮০ করে ফেলেছে। মাল্টা ১৪০। চেনার মধ্যে চিনি এক রুই মাছ, সেটার দাম বাড়তি। গরুর মাংস তো ছোঁয়াই যায় না। মুরগির মাংসেরও দাম বাড়লো। চাল ৬০ টাকা আগে থেকেই হয় আছে। আর যা যা আছে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় তারও দামের হেরফের হবে দিন দুয়েকের মধ্যেই। ধারণা করি এসবই গেল বৃহষ্পতিবারের বাজেটের ধাক্কা। মানুষ বাজেট বুঝুক আর না বুঝুক, বাজেটের পর পর জিনিসপত্রের দাম একদফা বাড়ানো চাইই চাই।

এবার বাজেটের আগে খুব করে মাতামাতি হলো আবগারি শুল্ক নিয়ে। ব্যাংকে এক লক্ষ টাকার বেশি একবার জমা দিলে বা উঠালে আবগারী শুল্ক দিতে হবে এক বছরে ৮ শ টাকা। যেটা বেশির মানুষই জানেন না বা জানার চেষ্টা করেননি সেটা হলো আবগারী শুল্ক আগে থেকেই ছিল। তখন ১ লাখ টাকায় ৫০০ টাকা দিতে হতো, এবার থেকে ৩০০ বেড়ে ৮০০ হলো। এটুকুই। এটা আপনার গায়ে লাগছে, তার কারণ টাকাটা আপনার আমার পকেট থেকে সরাসরি বেরুচ্ছে। বিষয়টা সেজন্যই কারোরই ভালো লাগেনি। আর সরকারও যে এই বাড়তি শুল্ক থেকে খুব বেশি আয় করছে তা নয়, সাকুল্যে এই আয় ৬০০ কোটিও হবে না।

অথচ যা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার ছিলো সেটাই রয়ে গেলো আলোচনার অন্তরালে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবত কালের সবচেয়ে বড় বাজেট ছিলো এটা। ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার এই মেগা বাজেটের কত কত দিক নিয়ে কত প্রশ্ন করার ছিলো, সেগুলো কি করেছেন? জানতে চেয়েছেন কি এত বড় বাজেটের টাকা আসছে কোত্থেকে? কর ছাড়া আর কোন কোন খাত রয়েছে যেগুলো থেকে টাকা আসবে? কত টাকার বিদেশি ঋণ নিতে হবে? কত টাকা অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ধার করতে হবে? কত টাকার বিদেশি সাহায্য পাব? এই সাহায্য কিংবা ঋণের প্রভাব আমাদের সার্বভৌমত্বের উপর কতটুকু পড়বে?

একইভাবে গত বছরের বাজেটে কোন কোন খাতে বেশি টাকা গেলো? রাস্তা ঘাট, ফ্লাইওভার, ব্রিজ এসবে কত টাকা গেল? আসলেই কি এত টাকা লাগতো নাকি আরো কম খরচে কাজ করান যেত? দেশে কয়টা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হলো? শিক্ষায় যে পরিমাণ টাকা গেছে তাতে কি শিক্ষার মান নিশ্চিত করা গেছে? হাসপাতাল কয়টা করা হলো? স্বাস্থ্য খাতে যে টাকা দেয়া হয়েছে তাতে কি সেবার মান বেড়েছে? এবছর নতুন করে কোথায় কোথায় খরচ করা হবে? করে লাভ কি হবে? কতজন কে সামাজিক নিরপত্তার আওতায় আনা হয়েছে? কতজন কে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা হবে এবছর?

কোন কোন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে? কোন কোন খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে আয় বাড়বে? সরকারের সিস্টেম লসে কত টাকার ক্ষতি হয়েছে? সিস্টেম লস ঠেকাতে সরকার কি এবার আলাদা ভাবে কোনো বাজেট রেখেছে? সবচেয়ে বড় কথা প্রশাসনিক খরচ গেল বারের চেয়ে এবার অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা বেড়েছে, এর ফল কি পাবে জনগণ? সরকারি সেবা কি জনসাধারণ অব্দি পুরোপুরি পৌঁছবে? খরচ বাড়লেও সরকারি সেবার মান কেন বাড়ছে না?

মাথা ঘামানোর দরকার ছিলো এসব নিয়ে, অথচ এ প্রশ্নগুলো্‌ই তোলা হয়নি।

আর শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতিতে আসল সমস্যাটাই হলো এটা। বাজেট আসে, টাকা যায়, কিন্তু কাজ হয় না। সেবার মান আর বাড়ে না। দুর্নীতির ইঁদুর ফসল ঘরে ঢোকার আগেই সবটা সাবাড় করে ফেলে। অথচ সরকার সিস্টেম লস ঠেকাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না। সরকার দুর্নীতি দমনের পেছনে পয়সা খরচ করে না। সরকার টাকা পাচারকে হালকাভাবে নিতে শিখে গেছে। তাই ৭৫ হাজার কোটি পাচার হয়ে গেলেও সরকারের গায়ে লাগে না, অথচ ভ্যাটের পরিমাণ কমাতে গেলেই গা শিউরে ওঠে। আর এজন্যই বড় বড় বাজেটের ফল সাধারণ মানুষের জীবনে এসে পৌঁছায় না। কেননা এই বড় বড় বাজেটের জামানায় আমাদের যানজট একটুও কমেনি। চিকিৎসার মান খারাপ থেকে খারাপ হয়েছে। শিক্ষার মান নিয়ে কথা তুললে কপাল চাপড়ে কাঁদতে বসতে হবে। জীবনযাপনের খরচ বেড়েছে। তবু সরকারের খরচ বাজেট থেকে বাজেটেএ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত কয়েক বছরের বাজেট দেখলেই এর প্রমাণ পেয়ে যাবেন। অথচ এ নিয়ে প্রশ্ন না তুলে আবগারী শুল্কের ৩০০ টাকার পেছনে লেগে আছেন সবাই মিলে।

আমাদেরকে শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি পেয়ে বসেছে। তার কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের অলৌকিক প্রমাণ করতে চান। তারা ভাবেন সব সমস্যার সমাধান তাদের কাছেই আছে। যাদুর ছড়ি ঘোরালেই সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু আসলে সরকার অর্থনৈতিক সমস্যাকে রাজনীতি দিয়ে সমাধান করতে চাচ্ছে। এটা হবার নয়, এটা হবেও না। অর্থমন্ত্রী তার করা বাজেটকে বেস্ট বাজেট বলে ঘোষণা করেছেন ঠিকই, কিন্তু বছর শেষ দেখা যাবে এ বাজেটের খুব সামান্যই সাধারণ জনতার কাজে এসছে। এতো বড় বাজেটের প্রায় সবটাই শুয়োরের বাচ্চারা খেয়ে গেছে।

লেখক: জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :