অর্থলোভী অন্ধকারের গোষ্ঠী জাতির ভরসা নয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
 | প্রকাশিত : ০৪ জুন ২০১৭, ১৩:৪৫

যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করতে গিয়ে জন্ম নেয়া হেফাজতে ইসলাম তার বিষদাঁত ক্রমেই বের করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো যারা দেখতে চায়, যারা যেকোন উপায়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ চায়, যারা যেকোন উপায়ে শেখ হাসিনার সরকারের অবসান চায় তারা উল্লিসত শুধু নয়, তাদের অনেকেই হয়ে উঠছেন এই সাম্প্রদায়িক শক্তির সহযোগী বা উপদেষ্টা। কিন্তু দু:খজনক হলো, রাজনৈতিক কৌশল হোক বা যেকোন কারণেই হোক, হেফাজতের সাথে শাসক দল আওয়ামী লীগের সখ্যতা গড়ে উঠেছে বলে জনমনে ধারণা পাকাপোক্ত হচ্ছে। কিন্তু আমরাতো জানি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কারিগর নয়, বাস্তববাদী বাংলাদেশের দল।

শেখ হাসিনার নয় বছরের বাংলাদেশ শাসনের দিকে তাকালে দেখি অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁকে। অনেক বেশি সহিংসতা, অনেক বেশি ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে তাঁকে পথ চলতে হচ্ছে। এবং এর একটা বড় কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার। দেশি বিদেশি পরাক্রমশালী, বিত্তশালি গোষ্ঠির ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে কাজগুলো করতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র ছিল ২০১৩ সালের ৫ মে, যখন সারাদেশ থেকে মাদ্রাসার শিক্ষক আর ছাত্রদের নামিয়ে দিয়েছিল বিরোধী পক্ষ সরকার উৎখাতের জন্য। সেই টালামাটাল সময়ে যখন এই গোষ্ঠিকে কান ধারানো সক্ষম হয়েছিল, আজ স্থিতির সময় কেন আপোস করতে হবে তা বোধগম্য নয়।

আসলে বাংলাদেশের শাসনভার যখন শেখ হাসিনার হাতে তখন, মানুষ ভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তার ইতিহাসে, তার মুক্তির চেতনায়, যে চেতনা উদার, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ বহু ধর্মের, এই বাংলাদেশ বাঙালির যেমন, তেমনি সব নৃগোষ্ঠীরও। তাই আজ যখন মানুষ দেখে অন্ধকারের গোষ্ঠীর কথায় রাষ্ট্র সংস্কৃতির সিদ্ধান্ত নেয়, আজ যখন যুবলীগের নেতার মৃত্যুতে পাহাড় আগুনে ছাই হয়, যখন শাসক দলের লোকজন সাম্প্রদায়িক ও অসহনশীল আচরণ করে, তখন মুষ্ঠিমেয় সাম্প্রদায়িক মনন ছাড়া সব মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। সেই অতীত থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ দেখে আসছে এই সমাজ। কিন্তু এই বাংলাদেশ এখন তা নিয়মিত দেখছে। দেখছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণও।

আমাদের শাসন ব্যবস্থা ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যেভাবে চলেছে, তাতে নতুন করে, পাকিস্তানি কায়দায় সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হয়েছে। একথা সত্য যে, আমা্দের জাতীয়তাবাদের মধ্যে সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিকতা আছে, আছে শ্রেণিভেদ আর ব্যাপকভাবে আছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। কিন্তু একথাওতো সত যে, এতোসব দ্বন্দ্ব আর বিরোধের পরও, নানা ধরণের অভ্যন্তরীণ সংঘাত থাকার পরও, সংহতি ও সমন্বয়ের এক বৃহৎ চিত্র বাংলাদেশ। কারা বারবার ধর্মকে ধর্মপ্রাণ উদার বাঙালির সামনে এনে সংঘাতের খেলা খেলছে সেই সন্ধান প্রয়োজন।

আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমা দর্শনের নয়। এর ধরণটা একেবারে নিজস্ব। এই ধর্মনিরপেক্ষতা যতটানা ধর্মের ব্যাপার, তার চেয়ে অনেক বেশি জীবনধারার। এখানকার মানুষ নিজের জীবনের নানা স্তরে ধর্ম পালন করেছে ঠিকই, কিন্তু কখনোই ধর্মকে সমাজের বৃহত্তরে পরিসরে টেনে এনে সংঘাত করেনি। এটা করেছে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি, করেছে তার দোসররা, যারা স্বাধীনতা চায়নি। এরাই এখন আবার সক্রিয় হয়েছে সেই জীবন ধারাকে বদলে দিয়ে কেবল ধর্মকে সমাজের উপজীব্য করতে।

সময়টা বেশ জটিল। অনেক সংগঠিত এই চক্র। তদের ঐক্য অনেক দৃঢ়। প্রশ্ন হলো পারবেন কি শেখ হাসিনা সেই জীবন ধারার ধারণাকে ভিত্তি করে এগিয়ে নিয়ে যেতে এই দেশকে? বাংলাদেশের রাষ্ট্র-সরকার-সমাজকে সংকীর্ণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দেখা মানে, একটা সংখ্যালঘু অন্ধকারের গোষ্ঠির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া। এই দৃষ্টিভঙ্গির গ্রাস থেকে আওয়ামীলীগকে মুক্ত করাও শেখ হাসিনার আরেক চ্যালেঞ্জ। যেভাবে এই দলে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তাতে এই দলের বহু নেতা কর্মীর মধ্যেই এখন অসাম্প্রদায়িক চেতনা কাজ করেনা। ধর্মীয় হিংসা বরদাস্ত করা হবেনা, এমন কথা ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে উচ্চারিত হয় ঠিকই, তবে তা বাস্তবায়িত হয় কম।

নয় বছর পার করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সামনেও তাকে পথ চলতে হবে আমাদের সমাজের ভেতরকার সেই ধর্মীয় বহুত্ববাদের কাঠামোকে বাঁচিয়ে রেখেই। তা না করে আধুনিক আওয়ামীলীগ নির্মাণের বদলে হেফাজতের চাপে দল যদি পিছন দিকে হেঁটে স্লোগান তোলে তবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের কোন চিণ্হ অবশিষ্ট থাকবেনা।

আর এই পথ বাজার অর্থনীতির পক্ষেও অনুকূল হবে না। শেখ হাসিনার আমলে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন দেশে উন্নয়ন ও আর্থিক সাফল্য যে এনেছে, তাকে ধরে রাখতে গেলেও সাম্প্রদায়িক পশ্চাৎমুখী রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে। তবেই উদার আর্থিক নীতি, বাজার ও বেসরকারিকরণের বদ্ধ দুয়ারগুলো আরও বেশি বেশি করে খুলতে থাকবে। ভরসা একটাই আর তাহলো ব্যাপক, বিরাট অসাম্প্রদায়িক জীবন ধারার মানুষ। এই অন্তর্নিহিত শক্তিই শেখ হাসিনার বড় ভরসা, অর্থলোভী কোন অন্ধকারের গোষ্ঠী নয়।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: পরিচালক- বার্তা, একাত্তর টিভি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :