পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু: শোকে স্তব্ধ মা-বাবা

প্রকাশ | ০৫ জুন ২০১৭, ১১:২৮ | আপডেট: ০৫ জুন ২০১৭, ১১:৩৩

জাভেদ হোসেন, গাইবান্ধা

‘তোমাদের মতো বড় লোক মানুষের বাড়িত আমি মাছ বেচিয়া আমার ছোলগুলাক লেখাপড়া করাই। তোমরা আমার ছোলেক আনি দ্যাও, আমার ছোলের কোনো দোষ আছিল ন্যা। আমরা ওই গাড়িত (পুলিশের মাইক্রোবাস) যাবার চাছিলাম, কিন্তু পুলিশ নেয় নাই।’

এভাবেই কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বললেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের হাতিয়া গ্রামের পুলিশ হেফাজতে থাকা ট্রাকচাপায় নিহত কলেজছাত্র রিপন চন্দ্র দাসের বাবা বাবলু চন্দ্র দাস। মা শ্রীমতি সুযোগী রানী এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন।

জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের চৌরাস্তা বাজার থেকে আধা কিলোমিটার পূর্ব দিকে হাতিয়া গ্রাম। রবিবার বিকাল চারটার দিকে ওই গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল সুন্দরগঞ্জ থানার কিছু পুলিশ সদস্য সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন।

রিপন চন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, আঙ্গিনায় রিপনের শ্রাদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। মা-বাবা, ভাই ও স্বজনরা কান্নাকাটি করছেন। আশেপাশের বিভিন্ন বাড়ি থেকে মানুষ এসে ভিড় জমিয়ে আছে তাদের চোখও অশ্রু সজল।

পুলিশ জানায়, গত ২৫ মে রিপন চন্দ্র দাস হাতিয়া গ্রামের একটি মেয়েকে (১৪) অপহরণ করে। এই ঘটনায় ওই মেয়েটির বাবা রিপন চন্দ্র দাসকে আসামি করে ৩১ মে রাতে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে গোপন সংবাদে বগুড়ার কাহালু উপজেলা শহরের একটি বাড়ি থেকে ওই মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। এসময় রিপন চন্দ্র দাসকে গ্রেপ্তার করে একটি মাইক্রোবাসে করে সুন্দরগঞ্জে আনা হচ্ছিল। পথে রিপন প্রস্রাব করার কথা বললে পুলিশ তাকে মহাসড়কের পাশে নামিয়ে দিলে প্রস্রাব শেষ না করেই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এসময় রংপুরগামী একটি ট্রাকের ধাক্কায় রিপন চন্দ্র দাস গুরুতর আহত হয়। পরে তাক পলাশবাড়ী  স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেয়ার পরই মারা যান রিপন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে রিপন সবার বড়। তিনি লক্ষ্মীপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেনির ছাত্র ছিলেন। দ্বিতীয় ভাই পণ্ডিত চন্দ্র দাস সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা উমেশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ও তৃতীয় ভাই শিপন চন্দ্র দাস বজরা হলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।

রিপনের পরিবারের দাবি, বাদীর যোগশাজসে পুলিশ তাকে হত্যা করেছে। সে কারণে তার মৃতদেহ পরিবার গ্রহণ করছিল না। পরে জেলা পুলিশ সুপারের অনুরোধে ছেলের লাশ গ্রহণ করলেও ভস্ম না করেই (আগুন দিয়ে না পুড়িয়ে) বাড়ি সংলগ্ন একটি স্থানে শনিবার দুপুরে রিপনের মরদেহ চাপামাটি দিয়ে রাখা হয়।

ওই গ্রামের কলেজছাত্র বিপুল সরকার বলেন, রিপন খুব ভালো ছেলে ছিল। এলাকায় তার অনেক সুনাম রয়েছে। সে ভালো ফুটবল খেলোয়াড়।

রিপন চন্দ্রের বাড়ি থেকে ২০০ গজ দক্ষিণে ওই মেয়েটির বাড়ি। সেই বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।

গত শুক্রবার দুপুরে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে মেয়েটির বাবার বাড়িতে ভাঙচুর করে। এরপর থেকে তারা আর এলাকায় থাকেন না।

স্থানীয়রা জানায়, তিন বছর আগে থেকে রিপন চন্দ্র দাসের সাথে ওই মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ঘটনাটি সম্প্রতি এলাকায় জানাজানি হলে মেয়েটির মতের বিরুদ্ধে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। ফলে তারা দুজনেই গত ২৫ মে পালিয়ে যায়।

রিপনের বাবা বাবলু চন্দ্র দাস বলেন, আমি মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

রিপনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে চার পুলিশ সদস্যকে গত শুক্রবার রাতে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই ঘটনায় সহকারী পুলিশ সুপার (বি-সার্কেল) মইনুল ইসলামকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ আতিয়ার রহমান বলেন, রিপন চন্দ্র দাসের মৃত্যুর ঘটনায় চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে ওই গ্রামে পুলিশ মোতায়েন আছে। পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/৫মে/প্রতিনিধি/এলএ)