সর্বগ্রাসী দূষণ-দখলে হুমকিতে গাজীপুরের বন-পরিবেশ

প্রকাশ | ০৬ জুন ২০১৭, ০৮:৩০

আবুল হাসান, গাজীপুর প্রতিনিধি

গাজীপুরে অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে পরিবেশ দূষণ। উজাড় হচ্ছে বন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য, দেখা দিচ্ছে নানা রোগ-ব্যাধি। হারিয়ে যেতে বসেছে নানা প্রাণী। আগ্রাসী দখল আর দূষণে নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। মরা খালে রূপ নিচ্ছে নদীগুলো।  ইটভাটায় অবাধে কাঠ পুড়ছে, বাতাসে বাড়ছে কার্বনের মাত্রা। তাতে প্রভাব পড়ছে কৃষি উৎপাদনে।

স্থানীয় অধিবাসীদের অভিযোগ, পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও প্রশাসনের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল। কিন্তু ভূমি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, বন বিভাগের উদাসীনতা আর ক্ষমতাশালীদের প্রভাবে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে এ বনের আয়তন। ইতোমধ্যে বনের জায়গায় রাস্তাঘাট, কারখানা নির্মাণ করায় হুমকিতে পড়েছে এর জীববৈচিত্র্য।

গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানটি ১৯৮২ সালে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেন। গজারিগড় বেষ্টিত আড়াইশ প্রসাদ, ভবানীপুর, বাড়ইপাড়া, ডগুরী, বন খরিয়া, বাওপাড়া, উত্তর সালনা, বাহাদুরপুর মৌজার ৬৫ হাজার ৩৮৫ একর জমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতায় আনা হয়। এসব সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রয়েছে হরেক রকমের গাছ-গাছড়া আর নানা ধরনের প্রাণী। তবে বনের ভেতরে স্থানীয় অধিবাসীদের জোত-জমি থাকায় তারা অবাধে বনে প্রবেশ করছে। আর এই সুযোগে বিভিন্ন কলকারখানার মালিক কৃষকদের কাছ থেকে জমি কিনে মিল কারখানা স্থাপনের নামে অবাধে বনের জমি দখল করে নিচ্ছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের গোচরেই কলকারখানার মালিক ও প্রভাবশালীরা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি গ্রাস করছে। প্রভাবশালীদের হাত থেকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি রক্ষা করতে না পারলে একদিন ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের গাছসহ জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা এখানকার বাসিন্দাদের।

বনকর্মী ও কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে জমি দখল, নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন গাজীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ইজাদুর রহমান মিলন।

তবে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম সংরক্ষিত বনের সংকটের জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে দায়ী করেন। তিনি জানান, বনের ভেতর কৃষকদের জমি থাকায় তারা অবাধে বনে প্রবেশ করছে। চাষাবাদে সার ও বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার করছে যা পরিবেশ দূষণ করছে। এ ছাড়া বনের পাশ দিয়ে যাওয়া মহাসড়কে গাড়ির নিচে পড়ে মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি।

এদিকে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বিভিন্ন এলাকায় বনের ভেতর অবৈধভাবে একের পর এক করাতকল গড়ে উঠছে। এসব করাতকলে শত শত গাছ চেরাই হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় বন কর্মকর্তা ও পুলিশকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে অবৈধভাবে এসব করাতকল চালানো হচ্ছে।

জানা গেছে, কালিয়াকৈর উপজেলায় সাড়ে ২১ হাজার একরের বেশি বন রয়েছে। এ বনকে কালিয়াকৈর ও কাচিঘাটা এ দুটি রেঞ্জে ভাগ করা হয়েছে। দুটি রেঞ্জের আওতায় বোয়ালী, রঘুনাথপুর, খলশাজানি, কাঁচিঘাটা, জাথালিয়া, গোবিন্দাপুর, চন্দ্রা, মৌচাক, বাড়ইপাড়া, কাশিমপুর, সাভার নামে ১১ বিট অফিস আছে। এর মধ্যে জাথালিয়া, কাঁচিঘাটা, বোয়ালী, গোবিন্দাপুর, রঘুনাথপুর বিট অফিসে বেশি করাতকল গড়ে উঠেছে।

এ সুযোগে স্থানীয় গাছচোর চক্র রাতের আঁধারে সড়কের ধারে ও সংরক্ষিত বনের ভেতর থেকে গজারিসহ নানা প্রজাতির গাছ কাটছে আর প্রকাশ্যে এসব গাছ চেরাই করা হচ্ছে। উপজেলার রঘুনাথপুর, কাঁচিঘাটা, বোয়ালী, গোবিন্দাপুরসহ অন্যান্য ফরেস্ট অফিসেরও একই অবস্থা। এছাড়া সিটি করপোরেশন এলাকায় অবৈধ ইটভাটার কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। টনের পর টন গাছ এসব ইটভাটায় জ¦ালানী হিসেবে ব্যবহার করায় পরিবেশে কার্বনের পরিমান যেমন বাড়ছে তেমনিভাবে কমছে গাছের সংখ্যা। ইটভাটার ধূলো আর ধোয়ায় এলাকার ফসলী জমিতে দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ফসলহানি, ফল ও সবজি পচে যাওয়া, কুঁকড়ানোসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।  
নির্বিচারে নদীদূষণ ও দখল

দখল ও দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে গাজীপুরের বিভিন্ন নদ-নদী ও জলাশয়। দখলবাজদের দৌরাত্ম্যে অস্তিত্ব হারাচ্ছে নদী। বিভিন্ন কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। কেমিক্যাল মিশ্রিত কালচে ও নীল রঙের পানি ভয়াবহ দুর্গন্ধযুক্ত। এ পানি জমিতেও ব্যবহার করতে পারছেন না কৃষক। পানিতে দূষণের মাত্রা বেশি থাকায় অক্সিজেনের পরিমাণ নেই বললেই চলে। আর এতে করে এসব নদী ও খালে মাছসহ নানা জলজ প্রাণি হারিয়ে গেছে।

তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠছে ডায়িং, প্রিন্টিং, নিটিং, সিরামিক, ইটভাটাসহ শত শত কারখানা। এসব কারখানার অধিকাংশের ইটিপি না থাকায় সরাসরি বর্জ্য মিশছে নদীর পানিতে। এ ছাড়া বাসা বাড়ির মলমূত্র, গৃহস্থালী বর্জ্যও মিশছে নদীর পানিতে। ফলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে ভয়াবহ হারে।

ময়লার শহর গাজীপুর

বিভিন্ন এলাকায় যত্রতত্র ময়লা ও বর্জ্য ফেলায় ময়লার শহরে পরিণত হয়েছে গাজীপুর। এসব বর্জ্য পানিতে মিশে দূষণ ঘটাচ্ছের। আর এ দূষিত পানি ব্যবহারে আমাশয়, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আয়তন প্রায় ৩৩০ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ৩০ লাখ। শিল্পকারখানা আছে ১ হাজার ৮৮৬টি। অথচ এত লোকের, এত কলকারখানার বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকার পর্যায়ে নগরজুড়েই ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সামান্য বৃষ্টিতেই অনেক রাস্তাঘাট ময়লা পানিতে ডুবে যায়।

২০১৩ সালে টঙ্গী, গাজীপুর পৌরসভাসহ ছয়টি ইউনিয়ন মিলে সিটি করপোরেশন গঠিত হলেও এ নিয়ে কোনো মহাপরিকল্পনা হয়নি। দেশের অন্যতম শিল্প-অধ্যুষিত গাজীপুরে কলকারখানা, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর, সেখান থেকে কোনাবাড়ি রাস্তার পাশে শুধু ময়লা আর ময়লা।

পরিবেশদূষণের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, গাজীপুরে নদীদূষণ রক্ষায় একাধিক কমিটি কাজ করছে। দূষণ, দখল রোধ এবং নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিল্প কারখানার বর্জ্য ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন,  ‘এটি আমাদের পরবর্তী প্রজম্মের জন্য হুমকি। এ জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।’

(ঢাকাটাইমস/৬জুন/মোআ)