লাখ টাকার গাছ, লাখ টাকার পাখা

তায়েব মিল্লাত হোসেন
 | প্রকাশিত : ০৬ জুন ২০১৭, ১১:৫১

আমার পরিচিত একজন। স্বজনও বটেন। তার পুত্র যাবে ইউরোপে। কাজের খোঁজে। আর দশজনের মতোই পুত্রকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দর অবধি এসেছেন পিতা। আপাত শেষ দেখার পর্ব সমাপ্ত। পুত্রের উড়োজাহাজও আকাশে উড়লো। পিতা ফিরবেন বাসায়। কিন্তু আর ফেরা হলো না। ঢাকার বিমানবন্দর সড়ক যেই পার হতে যাবেন, অমনি এক বাস তাকে পিষে চলে গেল। অকালে না হলেও আকস্মিক এক প্রাণহানি। এই কষ্ট সেই পুত্র কোথায় রাখবে?

আমাদের রাজধানী শহরের বিমানবন্দর সড়ক যেন মৃত্যুর ফাঁদ পাতা এক ভুবন। পথচারী পারাপার প্রক্রিয়া নিরাপদ করতে উদ্যোগ-আয়োজন এখানে খুবই কম। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত সড়কদ্বীপ, বিভাজক সাজানোর ঝকমারি কারবার লেগেই আছে। সেই বিএনপি জোট সরকারের আমলে এমন এক ভাস্কর্য বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল যেখানে তাদের নির্বাচনি প্রতীক ধানের শীষ পর্যন্ত নকশায় ছিল। সরকার বদলের কারণে শেষে তা আর হয়নি। আবারো আলোচনায় এসেছে এই সড়কের নিসর্গ-নকশার নতুন কাণ্ডকারখানা। বনসাইয়ের মতো এক অদ্ভুতুড়ে গাছ লাগানো হয়েছে। বনসাই নামে পরিচিতি পেলেও নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা জানিয়েছেন, এগুলো এক জাতের খাটো রঙ্গন, চীনা রঙ্গন। বনসাই না রঙ্গন- সেই বিতর্কে আমাদের কাজ নেই। প্রশ্নটা হচ্ছে- দেশে এত এত বৈচিত্র্যমণ্ডিত গাছ-তরু-লতা থাকতে কিম্ভূত প্রকৃতির চীনের রঙ্গন লাগাতে হবে কেন?

শস্তার তিন অবস্থা হলেও কম দামের কারণে আমাদের দেশে দেদার বিকোয় চীনা পণ্য। চীনা রঙ্গনের বেলায় বিষয়টা কিন্তু ভিন্ন। বিমানবন্দর সড়কের পায়েচলা পথের ধারে যেগুলো লাগানো হয়েছে একেকটির দাম নাকি পড়েছে লাখ টাকার উপরে! আমাদের সড়ককর্তারা দেশের দেবদারু, জারুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগেশ্বর, নাগলিঙ্গম, তেলশুরের বদলে চীনের গাছের দিকে ঝুঁকলেন। গুপ্ত কবিও তাদের সুপ্ত বাসনা নিশ্চয় বুঝতেন! সেই ব্রিটিশরাজের সময়ে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন-

কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি,

বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।

দুই.

হাতি এমনি প্রাণী মরলেও তার দাম নাকি লাখ টাকা। জাদুঘরে হাতির দাঁতের যে পাখা তা আরো অমূল্য। দাম দিয়েই তো আর পাওয়ার জো নেই। সহজেই মিলবে কেবল তালের হাতপাখা। আর মিলবে বৈদ্যুতিক পাখা। একটুখানি সাশ্রয়ের জন্য এই পাখা কিনতে আমি যাই ঢাকার নবাবপুর রোডের পাইকারি বিপণিতে। দেশি এক ব্যবসায়ী ভাইয়ের সহায়তায় অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি মানেও নিশ্চিত হতে পারি। কষ্টের রোজগার থেকে একটু বাঁচাতে পারলে ক্ষতি কি। গণপ্রজার প্রতিষ্ঠানকে অবশ্য এসব ভাবনা ভাবতে হয় না। জনতার করে আর বিলে তাদের দিন চলে যায় বহাল তবিয়তে। যুগে যুগে আধুনিকও হতে হবে তেনাদের। প্রযুক্তির পরম আরাম যদি না মেলে, তবে তাকে আর ভালো থাকা বলা চলে! এর সঙ্গে সবাই নিশ্চয় একমত হবেন। তাই তো নতুন পরিকল্পনা, নতুন প্রকল্প। বিজ্ঞপ্তি নয়, দরপত্র নয়, ডাকো চীনের প্রতিষ্ঠান। চৈনিকের কাছেই আছে আরাধ্য হারবাল। কী? কী? কী? এই প্রশ্নওয়ালা কেউ আর আছেন! যারা আছেন, মুঠোফোনের ব্যস্ততায় তারা বোধহয় দেশের খবর রাখারও সময় পান না। ফেসবুকে একটু ঢুকলেই তো জানতে পারেনÑ লাখ টাকার পাখা বনবন করছে বঙ্গমুলুকে। বাস্তবে নয় কিন্তু, মাথায় মাথায়। মগজ আর মনন থেকে বেরুচ্ছে পাখা-সাহিত্য, ফ্যান-শিল্পকর্ম। বার্তা আর মিমের ছড়াছড়ি। এসব আবার লাখো লাইক পাচ্ছে, হাজারো শেয়ার হচ্ছে, ভাইরালও হয়ে পড়ছে। জনগণ উন্নত টেলিফোন চায়, কিন্তু লাখ টাকার পাখায় ভর দিয়ে নয়। আমাদের দূরালাপের ভাই- বেরাদররা এতে একটু নাখোশ, আছেন কষ্টে। কারণ মাধ্যম আর সামাজিকমাধ্যমের তোপে ভেস্তে যেতে বসেছে তাদের সাধের প্রকল্প। এতে নিশ্চয়ই খুশি হবেন তারানা আপা। তিনি তো আগে থেকেই লাখের পাখার বিরুদ্ধে হাওয়া দিয়ে আসছেন। একসময়ের পর্দার প্রিয়মুখ আপার ফ্যান মানে ভক্ত নাকি হালে আরো বাড়ছে। এ তো ভালো খবর, ভালো খবর! এগিয়ে চলুন, লাখের পাখার বিরুদ্ধে আমরাও আছি ভক্তবৃন্দ হয়ে।

তায়েব মিল্লাত হোসেন: সাংবাদিক, গবেষক ও সাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :