কীটনাশকে বাড়ছে রোগব্যাধির প্রকোপ

সৈয়দ শিশির
| আপডেট : ০৬ জুন ২০১৭, ১৮:৩৫ | প্রকাশিত : ০৬ জুন ২০১৭, ১৮:৩১

জীবন ধারণ এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন হলেও দেশে বর্তমানে ভেজাল খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি শাক-সবজিতেও কীটনাশক ব্যবহারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে ফসল উৎপাদনে অবাধে ব্যবহার হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক। এতে ফসল বিষাক্ত হয়ে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ছে, নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরা শক্তি। হুমকিতে পড়েছে প্রাণবৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য, বাড়ছে রোগব্যাধির প্রকোপ।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দেশের কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহার করছেন ব্যবহারিক জ্ঞানের ভিত্তিতে! বলতে চাচ্ছি, কতটুকু জমিতে, কোন ফসলে, কী পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করা দরকার, সে সম্পর্কে তাদের কোনো প্রশিক্ষণ বা প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কীটনাশকের ব্যবহার রোধে প্রশাসনিকভাবে তেমন কোনো সচেতনতামূলক পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

মানতেই হবে, খাদ্য যদি বিষাক্ত হয় তাহলে যে আর তাকে খাদ্য বলা যায় না। কৃষকের ফসলের মাঠ থেকে শুরু করে শহর-বন্দরের বাজার এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তার পাতে ওঠা পর্যন্ত যত রকম প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার মধ্যে অনেক গলদ ঘটতে শুরু করেছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, খাদ্য আর স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ থাকছে না। যতটা জানা গেছে, কৃষিজাত পণ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও কীটনাশক, ফল, মাছ, শাক-সবজিতে ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হচ্ছে। মিষ্টিতে কাপড়ের রং প্রয়োগ করা হয়। শুঁটকি মাছ সংরক্ষণে ডিডিটি ও হেপ্টাক্লোর ব্যবহার করা হয়। ডিডিটি, এলড্রিন, ক্রোমিয়াম, কার্বামেট, আর্সেনিক, সিসাÑ সবই মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ইতিমধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে মানুষের মৃত্যুর ৭০ শতাংশ কারণ হবে ভেজালযুক্ত খাদ্য।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও জরিপ বলছে, উৎপাদন পর্যায়ে কীটনাশক ও সংরক্ষণ পর্যায়ে ফরমালিনসহ রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহার খাদ্যকে বিষে রূপান্তরিত করছে। এসব খাদ্য গ্রহণে মানুষ লিভারসিরোসিস, হার্ট অ্যাটাক ও ক্যানসারের মতো মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু কৃষিপণ্যকে কীটনাশক থেকে রক্ষা করা গেলে যে মানুষ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে সাম্প্রতিককালে ৮২টি খাদ্যপণ্য পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাক-সবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে মানুষ বাঁচবে কী খেয়ে?

এনভায়রনমেন্টাল ওয়ার্কিং গ্রুপের এক জরিপ সূত্রে জানতে পেরেছিলাম, দেশের বাজারে বিক্রীত ৯৮ শতাংশ শাক-সবজিতে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আঙ্গুর, স্ট্রবেরি, কমলা লেবু ও আপেলে আরও বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসকদের মতে, ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ১০ ভাগ মূল কারণ হলো কীটনাশক মিশ্রিত ভেজাল খাদ্য গ্রহণ।

আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ, যে কারণে কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগটা শৈশব থেকেই। সেই কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, ফসলের মধ্যে ধানের পাশাপাশি হাইব্রিড জাতীয় সবজি চাষে ব্যাপক হারে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তাদের জানা নেই যে, কীটনাশক দ্বারা নানাভাবে ক্ষতি হতে পারে। কীটনাশক স্প্রে করতে গিয়ে কৃষি শ্রমিক সরাসরি এর সংস্পর্শে আসছেন, পরিবারের সদস্যরা সারাক্ষণ কীটনাশক ব্যবহারে যুক্ত হচ্ছে (স্প্রে মেশিনটি দামি হওয়ায় ঘরের ভেতরেই রেখে দেওয়া হয়), ভোক্তারা কীটনাশকযুক্ত ফসল খেয়ে এর ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি বছর ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশকের বিষাক্ততায় আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হয় কীটনাশকের কারণে।

কিডনি রোগ, লিভারের রোগ, ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট এখন খুব দেখা যাচ্ছে। নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মরা বাচ্চার জন্ম দেওয়া ও নবজাতকের মৃত্যু অনেক বেড়ে গেছে। তাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফসল উৎপাদনে কীটনাশক ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিচ্ছে। ১৩টি কীটনাশক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যার মধ্যে ডিডিটি অন্যতম (যা আমাদের দেশে শুঁটকিতে ব্যবহার হচ্ছে)।

যতদূর জানা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কীটনাশক তৈরি ও তা বাজারজাত করছে। অনেকে আবার আমদানিও করছে। এর বাইরে ভারত থেকে চোরাই পথে আসা কীটনাশক, ছত্রাক, আগাছানাশকও ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, চাষিরা কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরামর্শ নিচ্ছেন দোকানিদের; কৃষি কর্মকর্তাদের নয়। এতে অনেক ক্ষেত্রে তারা সঠিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগে ব্যর্থ হওয়ায় ফসল ও সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সব ধরনের কীটনাশক মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। যা শুধু জনস্বাস্থ্যই নয়, পশু-পাখি ও মৎস্যসম্পদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আমদানি করা বালাইনাশকের ৬০ ভাগই ব্যবহার হয় ধান উৎপাদনে। যেটা কোনো না কোনোভাবে মানবদেহে প্রবেশ করছে। বর্তমানে দেশে ৮ ধরনের ২২৮টি মাকড়সানাশক, ৭৯ ধরনের ১০১৫টি ছত্রাকনাশক, ২৫৮৮ ধরনের কীটনাশক, ৫১ ধরনের ৬৯১টি আগাছানাশক, ২ ধরনের ১৩টি ইঁদুরনাশক, ৮৮ ধরনের ৭১৭টি জনস্বার্থ কীটনাশক রয়েছে। গুদামজাত শস্যের পোকা দমনের জন্য ৪ ধরনের ৮৯টি কীটনাশক রয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ৫৩৫৯ ধরনের পেস্টিসাইড বাজারে সরবরাহ আছে। এগুলো কোনো রকম মনিটরিং ছাড়াই সর্বত্র বিক্রি হচ্ছে। সহজলভ্য হওয়ায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা অনায়াসে ফসল এবং খাদ্যদ্রব্যে মেশাচ্ছেন। আর টাকা দিয়ে আমরা বিষ কিনে খাচ্ছি!

সম্প্রতি ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) নমুনা সংগ্রহ জরিপে রাজধানীসহ সাভার, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, কাপাসিয়া, গাজীপুর, কালিয়াকৈর, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীসহ কয়েকটি বাজারের ফুলকপি, বেগুন, শিম, লালশাকে মারাত্মক আকারে কীটনাশকের উপস্থিতি পেয়েছে। নমুনা পরীক্ষায় ২৭টি ফুলকপির মধ্যে ৮টিতে ম্যালাথিয়ন, ক্লোরোপাইরিফস, প্যারাথিয়ন মিথাইল ধরনের কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। এসব ফসলে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১৩ থেকে ২৬ গুণ পর্যন্ত বেশি বিষক্রিয়া রয়েছে। প্রতি কেজি ফুলকপিতে ২০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ম্যালথিয়ন সহনীয় মাত্রা হলেও পাওয়া গেছে ৭২৯ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। এছাড়া প্রতি কেজিতে ৫০ মিলিগ্রাম ক্লোরোপাইরফস সহনীয় হলেও বিদ্যমান আছে ১৬০৫ মিলিগ্রাম। বেগুনের ২৭টি নমুনার মধ্যে ১২টিতে ১৪ গুণ বেশি কুইনালফস উপাদান রয়েছে। প্রতি কেজি বেগুনে ১০ গ্রাম কুইনালফস সহনীয় হলেও ১২৪.২৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিদ্যমান আছে।

তাহলে কি এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই? আছে। তাই সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছি, আশির দশকের পূর্ব পর্যন্তও দেশের ৯০ শতাংশ কৃষক জৈব পদ্ধতিতে (অর্গানিক) চাষে অভ্যস্ত ছিলেন। তারপর নানা প্রলোভনে পড়ে তারা রাসায়নিক কৃষিতে ঝুঁকে পড়েন। বলতে চাচ্ছি, বিশ্বে যখন অর্গানিক কৃষিতে কৃষকদের আগ্রহ বেড়ে চলেছে তখন বাংলাদেশে এর মাত্রা খুবই কম।

তাই বলছি, কৃষি অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি সাধনে পরিবেশবান্ধব তথা জৈব পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন আজ সময়ের দাবি। আশার বার্তা হলো, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অর্গানিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। অর্গানিক পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু কি তাই? বরং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বদলে পরিবেশবান্ধব জৈব পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করে মানুষের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দেওয়াও সম্ভব।

উন্নত বিশ্ব এখন জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের প্রতি বেশ জোর দিয়েছে এবং এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত শস্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জৈবসার প্রয়োগ ও জৈব বালাইনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল এবং সবজির উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫%-৩০% কমিয়ে আনা সম্ভব। জৈবসার ব্যবহার করলে ফসলের উৎপাদন খরচ রাসায়নিক সারের চেয়ে শতকরা ৫০%-৬০% কম হয়। অপরদিকে রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়া পর্যায়ক্রমিক শস্য চাষ এবং মেহগনি, পীতরাজ, গাছ আলু ও নিমের নির্যাস ব্যবহার করে সবজি ও অন্যান্য ফসলের রোগবালাই দমন করা সম্ভব হয়েছে। কম খরচে শস্যে এ ধরনের জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে একদিকে যেমন কৃষকদের অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব, তেমনি জনস্বাস্থ্যও রক্ষা করা সম্ভব।

খাদ্যে ভেজাল মেশানো ‘পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯’ অনুযায়ী একটি অপরাধ বিবেচনা করা হলেও ভেজাল রোধে প্রয়োজন মতো উক্ত আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। জনস্বার্থে যত দ্রুত সম্ভব আইন প্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কেননা যেভাবে রোগব্যাধি বাড়ছে, সেটিকে সহজ করে দেখার সুযোগ নেই। তাই এমন কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত হোক, যেন খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থ বা ভেজাল মেশানোর সর্বগ্রাসী প্রবণতা রোধ হয় এবং রোগব্যাধি বৃদ্ধির হাত থেকে মানুষ রক্ষা পায়।

সবশেষে বলছি, অতি জরুরি কোনো ক্ষেত্রে কৃষকের কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হতেই পারে। তবে এক্ষেত্রে তাদের সহনীয় মাত্রা ব্যবহার ও বিকল্প পদ্ধতিতে কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় তাদের রাসায়নিক কীটনাশক পরিহার করে ভেষজ কীটনাশক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে সুশীল সমাজসহ সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যমকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমরা পেতে পারি কীটনাশকমুক্ত খাদ্য ও শাক-সবজি।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :