হোক না আজ একটু পুলিশ বন্দনা...

ডা. এস এমজি সাকলাইন রাসেল
| আপডেট : ০৭ জুন ২০১৭, ১৮:২০ | প্রকাশিত : ০৭ জুন ২০১৭, ১৫:১৯

হোক না আজ একটু পুলিশ বন্দনা। কিংবা কিছু সত্যের বন্দনা। নেগেটিভের ভিড়ে যে সত্যগুলো প্রায়ই আড়াল থেকে যায়। ভাল কথা সামনে ঈদ। ঈদ কি ঢাকায় করবেন না দেশের বাড়িতে? দেশের বাড়ির ঈদের মজাই আলাদা। প্রিয় গ্রাম প্রিয় মানুষ আপনজন।

আহা! কত সুন্দর এই গ্রামের উৎসবগুলো। শহরেরটাও খারাপ না। বিশেষ করে যার জন্মটাই শহরে। তিনি শহরেই বেশি আনন্দ পান। কিন্তু পুলিশের কথা ভাবেন তো। কিছু পেশার মত পুলিশও আজ আতঙ্কে। বসের হুমকি। গত ঈদ তো পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছেন। এবার নো ছুটি। চিকিৎসকেরও ছুটি নাই। তিনি ঈদ করবেন হাসপাতালেই মানুষের সঙ্গে। সাংবাদিকও অফিসে মানুষের সঙ্গে।

কেবল পুলিশই থাকবেন রাস্তায়। অমানুষ ঠেকাতে। সবাই যখন ঈদগাহ ময়দানে সেজদায়। পুলিশের আঙুল তখন বন্দুকের ট্রিগারে, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। ইবাদত থেকেও বঞ্চিত তিনি। হয়ত মনের কষ্টটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয়ে আসে।

‘আল্লাহ্‌ মাফ করে দিও, ঈদের নামাজ পড়তেও পারছিনা’ সান্ত্বনা এটাই অন্যের নামাজে আমি সহায়তা করছি।

ঈদের আগের দিন টিভি পত্রিকায় হেডলাইন ‘ঈদ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে’। এই চাদরে সুতাগুলোকে পুলিশ বলে।

একটা জিনিস খেয়াল করেছেন কি না, সারা দুনিয়া এখন সন্ত্রাসীপনায় ক্লান্ত, বাদ যাচ্ছে না আমেরিকা, বৃটেন, কানাডা, সুইডেন, ফ্রান্সও। বাদ পড়েনি আমার এই বাংলাদেশও। পশ্চিমা কুরাজনীতির উদরে জন্ম নেয়া জঙ্গিবাদ এদেশকেও রক্তাক্ত করেছে। অনেকেই ধরে নিয়েছিলাম আমরা বুঝি আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ভাবেন তো এখনকার পরিস্থিতিটা। শান্ত দেশ অন্তত অস্থিরতা থেকে। কেমনে হলো, কিভাবে হল আপনাকে ভাবতে হবে।

রাজনীতির মারপ্যাঁচ থেকে বেরিয়ে এলে অবশ্যই মন বলবে, ধন্যবাদ বাংলাদেশ পুলিশ।

উপর মহলের কালো হাত না থাকলে আমাদের পুলিশ যে কোনো রহস্যের বেড়াজাল ভাঙতে পারে এটা চ্যালেঞ্জ আমার। ছোট্ট এই জীবনে এমন ঘটনা অনেক দেখেছি।

আচ্ছা, পুলিশের কথা বাদ দেন। চলেন একটা সাধারণ জ্ঞান মুখস্থ করি। বলুন দেখি, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রাণ দেয় কোন পেশার মানুষ? উত্তরটা খুব সোজা। মুখস্ত করার তাই দরকার নেই! হ্যাঁ, পুলিশ।

চিকিৎসকরা মার খান, আহত হন সাংবাদিকরাও। কিন্তু প্রতিবছরই জীবন দেন কোনো না কোনো পুলিশ। এ সংখ্যা একজন দুজন পুলিশ নয়। একাধিক পুলিশ।

ছবিটা দেখেন...বোঝাই যাচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সেই আর্মি শাসনের সময়ে আদালত প্রাঙ্গণে কত কষ্টে আগলে রাখার চেষ্টা করছেন পুলিশরা...ভিড়ের চাপে একসময় মহিলা পুলিশরা পড়ে যান...তখন এগিয়ে আসেন পুরুষ পুলিশ (পিছনে হাত দেখা যাচ্ছে...সংগত কারণে পুরো ছবি দেয়া হয়নি)..নাম তার মোকসেদ...

সামান্য একজন পুলিশ! মূল ছবি দেখলেই বোঝা যাবে কত অসামান্য শারীরিক শক্তি দিয়ে নিরাপদ করতে চেষ্টা করছেন আজকের প্রধানমন্ত্রীকে!

অথচ তিনি আগলে রাখতে পারেননি নিজেকে। আটকে রাখতে পারেননি মৃত্যুদূতকে! একদিন ফোন দিয়ে জানালেন রাতে ফিরতে দেরি হবে। রাত গড়িয়ে ভোর হল তিনি এলেন না। পত্রিকার পাতায় এলেন খবর হয়ে প্রথম আলোর এক কোণায় ‘পুলিশের লাশ উদ্ধার!’

৪১ বছর বয়সেই চলে গেলেন ওপারে। আজও জানা হল না। এই পুলিশ কিভাবে মারা গেলেন! পরিবার জানে দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেছেন! মর্গে লাশটাকে এপার ওপার সরিয়ে দেখেছি। ডান কানের ওপর গর্তটা মগজ পর্যন্ত বিস্তৃত।রাজারবাগ পুলিশ লাইন মসজিদ থেকে পুলিশের গাড়িতে চড়ে শেষ যাত্রা শুরু করলেন। পাশে বসে যাত্রাপথের দায়িত্ব পালন করলেন তারই একসময়ের সহকর্মীরা! মুখ তাদের অন্ধকারে ঢাকা!

কী আশ্চর্য এই পেশা। কোমরে বুলেট রেখেও ভয়ে থাকতে হয় কখন যে একটা বুলেট ছুটে আসে তার দিকে! বলতে বলতে আরেকটা সাধারণ জ্ঞান মনে পড়ে গেল। বলুন দেখি আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী দৈনিক কর্মঘণ্টা কত?

উত্তর- ৮ ঘণ্টা। অথচ বেশিরভাগ জুনিয়র অফিসাররা নাইট ডিউটি করেন ১২ ঘণ্টা। কাগজের হিসেবে যা ১৪ ঘণ্টাও পার হয়ে যায়।

এই স্ট্যাটাস থেকে বের হয়ে পুলিশের ব্যারাকে যাই। কিংবা হাইওয়ের পাশের পুলিশ ফাঁড়িতে।কেবলমাত্র সেখানে গেলেই বুঝবেন সকালে যিনি আপনাকে আলোর পথ দেখাবেন জীবনের এই আয়েশ করার সময়টুকু তার কতটা অন্ধকারে ঢাকা!

বারান্দাতেই কাটে কারো কারো প্রতিদিনের জীবন! ডাইনিং এর খাবার, আর গণশৌচাগারের কথা বাদই দিলাম! অনেক গরম পড়েছে। এসময়ে এতো বড় একটা স্ট্যাটাস পড়া সত্যিই কষ্টের! রিকশায় বসেই গরম লাগে। ফ্যানেও গরম লাগে! এসি থাকলে কিছুটা স্বস্তি!

কিন্তু একজন ট্রাফিক পুলিশ কিংবা একজন ট্রাফিক সার্জেন্টের কথা ভাবেন তো। রাস্তাতেই জীবন তাদের কি রোদ কি বৃষ্টি! আপনি আমি ডিউটির ফাঁকে একটু চা খাই।এক আধটু আরাম করি। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের কথা ভাবুন তো। বিন্দু পরিমাণ এদিক ওদিক করার সময় নাই তাদের। সুযোগ নাই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ারও!

আগে তো তাও একটা মাথার ওপর ছায়া ছিল। রাস্তার ওপর সেড থাকত পুলিশ দাঁড়ানোর জন্য। এখন তাও নেই! খোলা আকাশটাই বড় ছাদ তাদের। এভাবেই প্রতিদিন মিনিমাম চয় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের এই দাঁড়িয়ে থাকাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কোনো এক চিকিৎসা বিজ্ঞানী। ভ্যারিকোস ভেইন বা আঁকাবাঁকা শিরার আরেক নাম তাই- ‘ট্রাফিক পুলিশ ডিজিজ!'

সম্মান দিয়েছিল আরও এক চিকিৎসক পেটের ভিতর ওমেন্টাম নামে যে পর্দা থাকে তাকে ‘অ্যাবডোমিনাল পুলিশম্যান' বলে। কারণ পেটে কোন জরুরি অবস্থা যেমন ছিদ্র, ইনফেকশন হলে এই পর্দা দ্রুত সেখানে গিয়ে সিল করে দেয়। পুলিশ যেমন কোথাও অন্যায় হলে ছুটে যান ঠিক তেমনি।

আর বেতন? শুনলে হাসবেন জুনিয়র পুলিশের বেতন তার নিজের চলার জন্য চলে। কিন্তু ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে সন্তানদের ভাল স্কুলে লেখাপড়ার চিন্তা করলে তা সত্যিই আকাশ কুসুম চিন্তা।

পুলিশের অবস্থা বুঝতে হলে এই স্ট্যাটাস পড়ার দরকার নাই। তাদের বহনকারী গাড়িগুলোর দিকে তাকাবেন। কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে লক্কড় ঝক্কর করে চলে সে গাড়িগুলো। যে লেগুনায় মানুষ ঠেকায় না পড়লে উঠতেই পারেনা সেগুলোই তাদের মেইন ভরসা।

এখনো পুলিশের চলার ভরসা রিকুইজিশন করা পাবলিক পরিবহন। সন্ত্রাসীরা চড়ে বেড়ায় কোটি টাকার BMW গাড়িতে। আর পুলিশ শুধুমাত্র W গাড়ি W stands for worst!

বিশ্রাম? ৩৬৫ দিনে মাত্র ২০ দিন। বাকি ৩৪৫ দিন যন্ত্রের মত দৌঁড়ান তারা। পরিবার থাকে তাই বঞ্চিত। জুনিয়রদের ওপর সিনিয়রদের কড়া আধিপত্যবাদের কথা বাদই দিলাম।

স্ট্যাটাস পড়ে কপাল কুঁচকাচ্ছেন? প্রচলিত ওই অভিযোগগুলোর কথা বলতে চাচ্ছেন?

হুম জানি সে অভিযোগগুলো চিকিৎসকদের কথাও জানি, জানি ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক, রাজউক, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গ্যাস, রাজনীতিবিদ, আমলা থেকে শুরু করে সবার কথা। কথা হবে কখনো সে সব বিষয় নিয়েও।এসব কথার কিছুটা সত্যও বটে।

তবে, সে বিষয়ে তর্ক করার আগে একটা তথ্য দিয়ে রাখি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি তথ্য সন্ত্রাসের শিকার হয় খুব সম্ভবত পুলিশ। এর পরের অবস্থানে নিশ্চয়ই চিকিৎসক থাকবেন। পুলিশে ডাক্তারে তাই অন্তত একটা জায়গায় মিল আছে তাহলো- ডাক্তার অপারেশনে থাকে,পুলিশ অপারেশনে বের হয়!

ভাল থাকুক এই অপারেশনবিদরা, ভাল রাখুক আমাদের।

সহকারী অধ্যাপক, ভাসকুলার সার্জারি বিভাগ, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল

ঢাকাটাইমস/০৭জুন/বিইউ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :