কাতার ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নয়া মোড়

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০১৭, ১৫:২৪

আমিনুল ইসলাম

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের দেশ কাতারের রাজধানী দোহার লোকজন ৫ জুন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শুনতে পেল প্রতিবেশী বাহরাইন তাদের সাথে সবধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। বিস্ময় না কাটতেই একটু পর আবার খবর এলো-বৃহৎ প্রতিবেশী সৌদি আরবও তাদের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরও এই পথে হাঁটে। কাতারের লোকজন রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। লোকজন পঙ্গপালের মতো সুপার মার্কেটে ছুটতে লাগলো জিনিসপত্র মজুদ করে রাখবে বলে। ব্যাংকগুলোতে গিয়ে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে গেল। প্রাথমিক ধাক্কাটা ভালোভাবেই সামলে নিলো কাতারের সরকার ও তার জনগণ। যে দেশ ৩৩৫ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ কিনে রেখেছে বহির্বিশ্বে, হঠাৎ করে তো তারা আর বিপদে পড়বে না। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের ব্যাংক মজুদ যেখানে ৩২ বিলিয়ন ডলারের মতো, মাত্র ২৫ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত কাতারের ৩৩৫ বিলিয়ন ডলারের শুধু বৈদেশিক বিনিয়োগ থাকাটাই প্রমাণ করে কাতার কতটা সচ্ছল। বার্সেলোনার মতো ক্লাবের স্পন্সর হয়ে এবং ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার সুবাদে কাতারের পরিচিতি অনেক।

ছোট জাতি হওয়ার কারণে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখার এক চেষ্টা সবসময়েই ছিল কাতারের। সুসম্পর্কগুলো ধরে রাখার জন্য কাতারের আমির হামাদ বিল খালিফা আল থানি আল-জাজিরা সংবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। আল-জাজিরার উপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে শুরু থেকেই প্রভাব বিস্তার করে আসছে। আল-জাজিরাকে ব্যবহার করে একদিকে যেমন আমেরিকার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে ঠিক তেমনি ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে খুশি করে ভারসাম্য বজায় রেখেছে কাতার। ইসরাইলের সাথে যেমন ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছে, তেমনি কট্টর ইসরাইলবিরোধী হামাস ও হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীকে অর্থসাহায্য দিয়ে তাদেরকেও হাতে রেখেছে কাতার। আল জাজিরার পাশাপাশি কাতার এয়ারওয়েজের জন্যেও বিখ্যাত কাতার। কাতার এয়ারওয়েজ আন্তর্জাতিকভাবে তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করে দোহাকে বিশ্ব পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলে।

মূলত আল-জাজিরা, কাতার এয়ারওয়েজ এবং গ্যাসের সমৃদ্ধতার কারণেই  ছোট, নিরীহ এই দেশ মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। আরব বসন্তের পর পুরো মধ্যপ্রাচ্য এক সময় নেতৃত্বের অভাবে ভুগছিল। ইরাকের অবস্থা তখন শোচনীয়। মিসর তার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। সিরিয়ার বিদ্রোহী দলরাও তখন মাথাচড়া দিয়ে উঠেছিল। বড় বড় দেশের মাঝে এমন সময় কাতার নেতৃত্বের সেই শূন্যস্থান পূরণ করে। কাতারের রাজধানী দোহায় আধূনিক উন্নয়নের কারণে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো সেখানে নিজেদের অফিস খুলে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে। অর্থ ও ক্ষমতার দিক থেকে কাতার এতটাই সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল যে চিকিৎসাখাতে মিশরকে আট মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়।

মধ্যপ্রাচ্যে সেই কাতার আজ একঘরে। এখন পর্যন্ত সাতটি দেশ কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিলেও এ সিদ্ধান্ত যে হঠাৎ আসেনি-তাই মনে করেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। দুই সপ্তাহ আগে আল-জাজিরাসহ কাতারের সংবাদমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেয় মিসর, সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। সম্প্রতি কাতারের আমির সৌদি আরবের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানবিদ্বেষী মনোভাবেরও সমালোচনা করেন তিনি। এতে ক্ষুব্ধ হয় সৌদি আরব ও তার মিত্ররা। কাতারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে কাতার মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ জিহাদি গোষ্ঠীকে অর্থসাহায্য দেয়-যেটা পুরোটাই সৌদি স্বার্থবিরোধী কাজ।

এক নজরে কাতারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হচ্ছে-

১. হামাসকে সহায়তা

২. হিজবুল্লাহকে সহায়তা

৩. সিরিয়ান বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থের যোগানদান

৪. আল-কায়েদার সাথে সম্পর্কিত নুসরার ফ্রন্টের সাথে কাতারের সংশ্লিষ্টতা

৫. মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে সহায়তা

৬. সৌদি আরবের চরম দুশমন ইরানের প্রতি সহানুভূতিশীল

কাতারের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্যের এই টানাপোড়েনের পেছনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দূষছে সৌদি-আরবের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইরান।

বিশ্বরাজনীতির মোড়ল আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের এই নতুন পরিস্থিতিতে কোনো মতেই লাভবান হতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বিমানঘাঁটির সদরদপ্তর হচ্ছে কাতারে। প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সৈন্য এই মুহূর্তে কাতারে মোতায়েন আছে। কাতারের এই ঘাঁটিকে কেন্দ্র করেই ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক তৎপরতা পরিচালিত হয়।

যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের এই পদক্ষেপকে একপ্রকার সমর্থন জানিয়েছেন। বলেছেন-তার সাম্প্রতিক সৌদি সফরে জঙ্গিবিরোধী ভূমিকার সুফল আসতে শুরু করেছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো-একঘরে হয়ে পড়া কাতার কখনোই আমেরিকা ও তার মিত্র সৌদি আরবের জন্য ভালো হবে না। ইরান কাতারের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কাতারে খাবার পাঠানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাতার সমস্যার হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছেন। কাতার যদি ইরান-তুরস্ক-রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে সৌদি-আমেরিকা জোটের বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। যদিও এই অচলাবস্থা নিরসনের জন্য কুয়েতের আমির দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। সময়ই বলে দেবে-সামনের দিনগুলোতে কী অবস্থা হয়। বাংলাদেশের জন্য এই অচলাবস্থা যথেষ্ট দুশ্চিন্তার-কারণ মধ্যপ্রাচ্য অস্থির হলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। কাতারেই প্রায় তিন লাখের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন।

লেখক: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক