মূর্তি বা ভাস্কর্য

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০১৭, ১৩:৩৭ | আপডেট: ১১ জুন ২০১৭, ১৩:০৮

সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম

হুজুগে বাঙালি আমরা বর্তমানে নতুন একটি উপসর্গে আক্রান্ত হয়েছি। আমরা এখন ইস্যু বাতিকের শিকার। ইস্যুতে ইস্যুতে মতবিরোধ, ইস্যুতে ইস্যুতে হানাহানি- আমরা ইস্যু থেকে  ইস্যুতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছি। নিত্য নতুন ইস্যুতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরাতন ইস্যুগুলোর গুরুত্ব ভুলে যেতে ভালবাসি। যেন ইস্যু থেকে ইস্যুতে লাফিয়ে চলাই জীবনের গতিশীলতা,  ছন্দময়তা।

ইদানিং তেমনি একটি  ইস্যু হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত একটি  স্থাপনা স্থানান্তর।

এ নিয়ে আমার ভাবনার কথা আমি আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে লিখতে ইচ্ছে প্রকাশ করছি। বিষয়টি  হয়ত আমার জন্য দুঃসাহসিকতা, তবুও লিখতে মন চাইছে কেন জানি না। 

কয়েক মাস আগের কথা। কোন একদিন সকালে আমার স্বামী আমাকে হাইকোর্টে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। মহামান্য  সুপ্রিম কোর্ট  গেইট দিয়ে গাড়িটি প্রবেশের সাথে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত দাঁড়িপাল্লা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নারী প্রতিকৃতি দেখে  আমার স্বামী স্বভাব সুলভ  কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেন এরকম একটি অসামঞ্জস্য মূর্তি হাইকোর্টের সৌন্দর্যের সাথে ঠিক মিলছে না! আমি তার চেয়ে বেশি বিরক্ত নিয়ে বলি ‘সব কিছুর মধ্যে  ‘negative’  খুঁজবে না তো। কিন্তু এরপর থেকে যতবারই আমি সেই ভাস্কর্য বা মূর্তিটির (?) পাশ দিয়ে গিয়েছি এবং যতবারই সেটির দিকে  তাকিয়েছি এবং  ততবারই সেই মূর্তি বা ভাস্কর্যটি (?)  আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে দুর্বোধ্য মনে হয়েছে!   

ছোট বেলায় আমি খুব কাছ থেকে মাদুর পেতে বসে  মূর্তি গড়া দেখেছি। আমাদের বাসার পাশেই এক  ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল। তাদের বাসার সামনের ছোট্ট মাঠে সার্বজনীন দুর্গাপূজার আয়জন করা হতো। আমরা পাড়ার ছোটোরা খড় পেঁচিয়ে মূর্তির কাঠামো গড়া থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ মূর্তিগুলোকে গহনা কাপড় দিয়ে সাজানো পর্যন্ত সময় পেলেই এক মনে বসে বসে দেখতাম। পূজা মণ্ডপে শুরু থেকেই সামনে মাদুর বিছিয়ে রাখা হতো যাতে করে যে কেউ বসে বসে মূর্তি গড়া দেখতে পারে।  আমি দেখেছি একজন মূর্তির কারিগর ‘পাল’ কীভাবে অন্তর নিংড়ানো ভক্তি আর মনোযোগ নিয়ে একটি  মূর্তি তৈরি করেছেন। পেঁচানো খড়ের উপর নিখুঁত লালিত্যে মাটির প্রলেপ দিয়ে দেহ কাঠামো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অনেক সময় দেখেছি  মাটির প্রলেপে দেহের কাঠামো, চোখ, নাক, ঠোঁট ফুটিয়ে তোলার সময় বার বার হাতের পিঠে চোখের  পানি মুছতে। যততুকু তখন বুঝতাম তাতে  বুঝেছি বা জেনেছি একজন সহজ, সরল, দরিদ্র ধর্মভীরু ‘পাল’ মূর্তিটি গড়ার সময় তার অন্তরের ভালবাসা, ভক্তি আর বিশ্বাস ঢেলে দিয়ে এক একটি প্রতীকী মূর্তির আদর্শগত রূপ সর্বাঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন সতর্কতার সাথে। তাদের সরলতা আর ভক্তি মেশানো নিখুঁত কারুকাজ যে কোনো ধর্মের মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে।

মূর্তি আর ভাস্কর্য সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা আমি পেয়েছি তার মধ্যে একটি এরকম–

Statue: a large art object, often representing a person or an animal, that is made from a hard material, esp. stone or metal.

Sculpture: is a type of artwork that's two-or three-dimensional, so we can see it from different sides. We  can make sculpture from clay, marble, wood, and even mashed potatoes.

From the Latin sculpere ‘to carve,’ sculpture often is carved out of a block of wood, stone, or other material. Statues and outdoor artworks are one type of sculpture, and they are freestanding— you can walk around them, under them, or even over them. Other types are carved into walls, with the figures or objects sticking out from a flat surface. Artists called sculptors use soft materials, metal, and even ice and common objects like cars and cans to make sculpture. (Internet)

ব্যাখ্যা অনুযায়ী সাধারণত মূর্তি বলতে বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা বিশেষ কোনো জীবের প্রতিস্থাপন আর যা কোনো শক্ত উপাদান ,পাথর বা ধাতব বস্তু দিয়ে প্রস্তুত করা হয়।

আর ভাস্কর্য  হচ্ছে শিল্পকর্ম। ভাস্কর্য সাধারণত করা হয়ে  কাঠ খোদাই করে, পাথর খোদাই করে অথবা অন্য কোনো ধাতব বস্তু খোদাই করে। ফাঁকা জায়গাতে স্থাপন করা ভাস্কর্যের চারিদিকে চলাফেরা করা যায়, এর নিচে চলাফেরা করা যায়, এমন কি এর উপরেও ওঠা যায়।  ভাস্কর্য শক্ত, নরম উপাদান এমন কি বরফ দিয়েও বানানো যায়।  

ভাস্কর্যের  উল্লিখিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী, হাইকোর্টের গেইটের সামনে স্থাপিত স্থাপনাটি  ভাস্কর্য হওয়ার কথা নয়। 

তবে স্থাপনাটিকে মূর্তিও বলা যাবে কি না আমি জানি না। কারণ ফুলহাতার গলা বন্ধ ব্লাউজ আর শাড়ি চুড়ি পরা হাতে তরবারি অন্য হাতে দাড়িপাল্লা এই স্থাপনাটি  কোনো ধর্মীয় দেবীর/ ব্যক্তিত্যের প্রতিমূর্তি সেটা আমার বোধগম্য নয়। এই মূর্তির দাবিদার কোন ধর্মের, কোন বর্ণের, কোন গোত্রের মানুষ বুঝে পাচ্ছি না । হিন্দু  পৌরাণিক যতটুকু জানি এমন কোনো প্রতীকী নারী মূর্তির অস্তিত্ব আছে কি না আমার এখন পর্যন্ত জানা নেই। গ্রিক পৌরাণিক যতটুকু জানি সেখানেও শাড়ি, চুড়ি, ফুলহাতের ব্লাউজ একহাতে তরবারি অন্য হাতে দাঁড়িপাল্লা এমন কোনো প্রতীকী নারী মূর্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার জানা নেই। গ্রিক পৌরাণিকের যে দেবী মূর্তিটি (THEMIS) ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা হাতে অধিষ্ঠিত হিসাবে দেখা যায় সে মূর্তিটির সাথেও এর কোনো সামঞ্জস্যতা দেখা যায় না। শাড়ি, চুড়ি, ফুলহাতের ব্লাউজ পরা এমন একটি দুর্বোধ্য যুদ্ধাংদেহী লালিত্যহীন  নারী মূর্তিকে তারা তাদের দেবী মূর্তি (THEMIS )  হিসেবে স্বীকৃতি দেবে কি না জানি না।

মহামান্য হাইকোর্টের একজন গর্বিত  আইনজীবী  হিসাবে গর্বের সাথে  বলছি  যে,  অর্থনীতি বিষয়ে ১৯৮৬ সালে সর্বচ্চ ডিগ্রি ধারণের পর কর্পোরেট জগতে কর্মরত থাকা অবস্থাতে ১৯৯৪ সালে  আইন পাশ করেছি, আইন পেশাতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি ধারণ করেছি। কর্পোরেট পেশা ছেড়ে ২০০০  সাল থেকে আইন অঙ্গনে নিয়মিত চলাফেরা। এই দীর্ঘ সময়  ধরে আমার অন্যতম দ্বিতীয় ঠিকানা, আমার কর্মস্থল , আমার অবাধ বিচরণক্ষেত্র, আমাদের অহংকার  সুবিশাল হাইকোর্ট চত্বরে ঢুকতে গিয়ে প্রতিদিনই গর্বিত চোখে  গ্রীবা উঁচু করে তাকিয়েছি শ্বেতশুভ্র কোর্ট ভবনটির দিকে। শ্বেতশুভ্র সম্পূর্ণ  ভবনটি স্বয়ং আমার চোখে ন্যায় বিচারের প্রতীক বলে মনে হয়েছে সবসময়, যার  ঠিক সামনেই স্থাপিত সবুজ রঙের  মানচিত্র ভবনটিকে দৃষ্টিনন্দন আর  মহিমান্বিত করেছে। 

প্রাসঙ্গিক ভাবে মহামান্য হাইকোর্ট ভবনের সামনে স্থাপিত মূর্তি / ভাস্কর্য ( ? )  অপসারণের ফলে যেসব  বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে প্রায় অজ্ঞ আমি দুই একটি বিষয় ধৃষ্টতা নিয়ে উল্লেখ করার ইচ্ছে প্রকাশ করছি। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বিজ্ঞ জনাবা সুলতানা কামালের সাথে আমার দেখা হবার সৌভাগ্য এখনো হয়নি তবে তাঁর মা,  বিশিষ্ট কবি বেগব সুফিয়া কামালের সাথে আমার একান্তে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছে ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে কোনো এক সময়। আমার স্বামী তখন নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমান জেলা ) সর্বশেষ মহাকুমা প্রশাসক। জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার ঠিক কিছু দিন আগে কোনো এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় উদ্যোগে কবি সুফিয়া কামালকে প্রধান অতিথি করে নেত্রকোনা আনেন। আমাদের বাংলোর কাছেই স্থানীয় ডাকবাংলোতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তবে তাঁর সান্ধ্যকালীন চা নাস্তা আর রাতের খাবারের ব্যবস্থা মহকুমা প্রসাশক অর্থাৎ আমাদের বাসভবনে করা হয়েছিল। আমি অবাক হয়ে দেখেছি তাকে  শুভ্রবসনে ঘোমটা মাথায়, মার্জিত রুচিশীল, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, সুক্ষ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা সম্পন্ন,  প্রকৃতিপ্রেমী  একজন ব্যক্তিত্বকে। জীবন্ত গাছপালা দিয়ে ঘর সাজানো অভ্যাস আমার ছোটবেলা থেকে। প্রায় নতুন  সংসারে  সরকারি বাসভবনে আসবাবপত্র  সব সরকারি। সেসব আমি দৃষ্টিনন্দন করতে জীবন্ত  গাছপালা দিয়ে সাজিয়েছিলাম। উনি আমার গাছপালা আর  গৃহসজ্জার প্রসংসা করছিলেন বার বার। রাতে  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছিলাম আমরা পাশাপাশি একটি সোফায় বসে, আমার কোলে বসে ছিল আমার  প্রথম সন্তান আমার ছেলে। কিছুই  বোঝার  বয়স  তখন তার  হয়নি তবুও পলকহীনভাবে সে অনুষ্ঠানটি দেখছিল। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা সম্পন্ন কবি সুফিয়া কামাল নিজে বিষয়টি আমার নজরে দেন। উনি বার বার বলছিলেন ‘আমি অনুষ্ঠান দেখবো কি, আমি অবাক হয়ে আপনার বাচ্চাকে দেখছি), ও একমনে অনুষ্ঠান দেখে যাচ্ছে, চোখে পলক পর্যন্ত ফেলছে না, কিছু খেতেও চাইছে না......!’ যতবারই আমি চোখ ফিরিয়ে ওনাকে দেখেছি ততবারই খেয়াল করেছি উনি আমার  ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি শুধু মনে মনে ভাবছিলাম – তাঁর মত মমতাময়ী বিদুষী, শিশুপ্রেমী মানুষের পক্ষেই বিখ্যাত ‘শিশু যাদুকর’  কবিতা লেখা সম্ভব।

বিজ্ঞ জনাবা সুলতানা কামার তাঁর মায়ের চরিত্রের কতটুকু পেয়েছেন জানি না  বা জানার  সৌভাগ্য এখনও আমার হয়নি। তবে হাইকোর্ট  প্রাঙ্গণে একটি  স্থাপনা স্থানান্তরিত প্রসঙ্গে কোনো এক অনুষ্ঠানে মসজিদ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য উপস্থাপনা  শ্রুতিমধুর মনে হয়নি। মসজিদ, মন্দির, গির্জা প্রার্থনার পবিত্র স্থান। মানুষ সেখানে উপস্থিত হন সর্বশক্তিমানের সান্নিধ্যের আশায়। সামগ্রিক পবিত্রতা রক্ষা করে আত্মার শুদ্ধির আশায় সমবেত হন সবাই সেখানে। যে কোনো ধর্মের আচার আনুষ্ঠানিকতা যা  কিছু সব জাগতিক জগতের প্রয়োজনে, আর  প্রার্থনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা পরকালের জন্য, সর্ব শক্তিমানের নৈকট্য বা  রহমত লাভের জন্য, আত্মার শুদ্ধির জন্য। মসজিদ, মন্দির, গির্জা সেই পবিত্র স্থান যেখানে প্রকৃত ধার্মিকরা সমবেত হন  পরম ভক্তি ভরে। কোনো ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা অবজ্ঞা নয় বরং শ্রদ্ধাবোধ প্রকৃত ধর্ম নিরপেক্ষতা।  

হাইকোর্টের প্রবেশদ্বারে স্থাপিত ভাস্কর্য কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় বা স্থাপনা নয়। এর সাথে তুলনা করে পবিত্র মসজিদসহ যে কোনো ধর্মীয় উপাসানালয় সম্পর্কে কটূক্তি যে কোনো প্রকৃত  ধার্মিকের মনে আঘাত লাগতে পারে। আমি নিজে মনের তৃপ্তির জন্য যখন যেখানে  যাই সেখানকার মসজিদসহ  ধর্মীয়  প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ চোখে দেখে আসি কাছ থেকে বা দূর থেকে। মনে প্রাণে যতটুকু ধার্মিক আমি তাতে মসজিদ সম্পর্কে অবজ্ঞা অন্তরে আঘাত হানে।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট , বাংলাদেশ